শিক্ষাবিদ রোকেয়ার ভাবনা গভীরতা
শিক্ষাবিদ রোকেয়ার ভাবনা গভীরতা
নারী ও পুরুষ মিলে মানব-সমাজ। এ ব্যবস্থার প্রগতি ও বিকাশের জন্য প্রয়োজন উভয়ের যৌথ প্রচেষ্টা। শাশ্বত অগ্রগতির পেছনে দরকার আলোকিত বিশ্বাস। যে বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি গড়ে ওঠে শিক্ষার দীপ্তিতে। কিন্তু চলমান সমাজ পশ্চাতে থাকার আধার খুঁজে নেয় নারী পুরুষের অসমতায়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীকে পুরুষের অধস্তন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এতেই শেষ নয়, নারীকে দেওয়া হয়না তার প্রাপ্ত সম্মান ও মর্যাদা। নারীর এ বঞ্চনা-বৈষম্যের প্রতিক্রিয়ায় পাশ্চাত্যে নারীবাদের উদ্ভব। কালে কালে সমাজে প্রকাশ পেয়েছে উদার নারীবাদ, আমূল নারীবাদ, মার্কসীয় নারীবাদ ও সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ ধারণা।
বঙ্গসমাজে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন উদার নারীবাদের পথিকৃৎ। একজন রোকেয়ার এই অগ্রপথিক স্বরূপকে চিনতে প্রয়োজন বাংলার-সমাজে দৃষ্টিপ্রক্ষেপণ। এ সমাজে নারীদের অবহেলার অন্যতম কারণ তাদের শিক্ষার অভাব। সভ্য পৃথিবীর মানুষ মাত্রই জানে শিক্ষা মানুষের চিন্তাধারা বদলিয়ে দেয়। সাহায্য করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে এবং অন্যকে সম্মান ও নিজকে পথ দেখতে। সবথেকে বেশি করে উদ্বুদ্ধ করে পরিবার ও সমাজে সত্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকার আদায়ের পথ প্রসারিত করে মানবিক সমাজ গড়তে।
দুর্ভাগ্য বাংলার নারীকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে অনেক আগে থেকে। দৃষ্টি অতীতে ফেরালে নজরে আসে স্বামী ছাড়া ভারতবর্ষের নারীর অস্তিত্বহীনতার কথা। এ পথে প্রথম মানবতার আলোর মশাল হাতে নামেন রাজা রামমোহন রায়। ১৮১২ সালে তিনি ব্রিটিশ শাসকদের কাছে হিন্দু নারীদের দুর্গতির কথা তিনিই স্পষ্ট করেন। একইসঙ্গে সরকারের সাহায্যে সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু করেন। সহযাত্রী হয়ে কাতারে দাঁড়ান ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। রামমোহন রায় ও বিদ্যাসাগরের ঐকান্তিক চেষ্টায় ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে পাশ হয় সতীদাহ বিলুপ্ত আইন। নারীদের অধিকার বোধ প্রতিষ্ঠার আর এক ধাপ এগিয়ে ১৮৫৬ সালে পাশ করিয়ে নেন বিধবা বিবাহ আইন। বাংলার নারীরা স্বীয় অধিকার আদায়ের ধারাবাহিকতায় প্রথম প্রবেশ করতে শুরু করে এ সময় থেকেই।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে শুরু হয় নারীশিক্ষা অধিকার আন্দোলন। এই শতকের শেষ দিকে মুসলিম নারীদের জাগাতে কুমিল্লায় নবাব ফয়জুননেসা চৌধুরী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারীদের ভেতর অন্ধকার দূর করতে সচেতনতার আলো নিয়ে এগিয়ে আসেন। সমাজের প্রচলিত অমানিশার উপর জ্ঞানের রশ্মি ঠিকরে পড়ে প্রচণ্ড গতিতে। পৃথিবীতে নারী স্বাধীনতার আবাহন অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে, কিন্তু এর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক আন্দোলনের উত্থান ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ হতে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। অবশ্য নারীশিক্ষার বিষয়টি নারীবাদী অভিধা পায় ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে। ১৯৩০ সালে নারী, স্বাধীনতা শব্দ দুটি আধুনিকতার বহুমাত্রিকতা লাভ করে। এ সময়ে ফরাসি নারী দার্শনিক ‘সিমোন দ্য বোভোয়ায়ে’র ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
সময়ের প্রবাহে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান নারীনেত্রী ‘ফ্রিজান’ এর ‘দি সেমিনাইন মিসটিকা’ গ্রন্থ এবং ১৯৭৮ খ্রি, একই দেশের আরেক বিখ্যাত লেখক ‘মেরি ডলি’ তাঁর `Gynecology’ বইয়ে সমাজের সকল ক্ষেত্রে পুরুষের প্রাধান্যের কথা বলেছেন। ঊনবিংশ শতকে নারীর অধিকার আলোচনা তুঙ্গে থাকার মুহূর্তে মুসলিম নারীকে জাগাতে মিশরীয় মুসলিম আইনবিদ ‘ক্কাসিম আমিনে’র ‘তাহারির-আল-মার’আ গ্রন্থটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। ঠিক সে সময়ে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের প্রতিভার কিরণ বড় বিস্ময় সৃষ্টি করে। আধুনিক যুগে বাঙালি ইতিহাসে রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন একটি আলোকিত নাম। যাঁর বিভার বিস্তৃতি নারী জাগরণের অগ্রদূত হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু এই বিশেষণের গভীরতা কোথায়? বিষয়টি বিশ্লেষণে তাই পরা-পাঠ্যের সীমানায় পৌঁছতে হয় আমাদের। প্রাচীন ইতিহাসে শশাঙ্ক, পাল, সেন বংশ পার হয়ে তুর্ক-আফগান শাসকের অধীনে ছিল বাংলা।। সরল অর্থে তারা সকলেই ছিল রাজা-ধিরাজ। রাজ্য নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিলেন তারা সকলেই। তবে এ সকল শাসক সব থেকে বেশি হরণ করেছিলেন মানুষের বাক-স্বাধীনতা। চিন্তার স্বাধীনতা। সভ্যতার পর থেকে মানুষ নিজস্ব ভাষায় তাদের ভাবনা- চিন্তাকে প্রকাশ করেছে। সঙ্গত কারণেই বাক-স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু শাসনক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখতে প্রত্যেক শাসক মানুষেরই মৌলিক অধিকারকে স্তব্ধ করার চেষ্টা করেছে। অনধিকার চর্চার এই বেআইনি ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে সচেতন মানুষ প্রতিবাদে সরব থেকেছে শুরু থেকেই। তারপরও মানুষ তার বাক-স্বাধীনতার প্রত্যাশিত অধিকার প্রাপ্তির বাইরে থেকে গেছে যুগে যুগে।
বিষয়টি নিয়ে উনিশ শতকের শেষ দিকে ‘দার্শনিক স্টুয়ার্ট মিল’ মানুষের মত প্রকাশের পক্ষে যা বলেছেন, তা আদৌ কপালে জোটেনি। তিনি বলেছেন, ‘একজন ব্যক্তির নিজেকে প্রকাশ করার অধিকার যতদূর পর্যন্ত তা অন্য ব্যক্তির ক্ষতির কারণ না হয়।’ (প্রথম পর্ব)