শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা

“যে প্রজন্ম নিজ চোক্ষে মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি তাদের জন্যই উপন্যাসটি পড়াটা অত্যন্ত জরুরী, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস –‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’- সম্পর্কে খ্যাতনামা মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক ও প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক এমনটাই বলেছিলেন। আজকের লেখায় তুলে ধরব ১৯৭১ সালে ১৪ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিজয়ের ঠিক আগেই, মাত্র ৪৩ বৎসর বয়সে ঢাকার মিরপুরস্ত বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নিকটে আল বদর বাহিনী হাতে নিহত খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক, কবি ও শিক্ষাবিদ শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশার কথা। গত ১৫ই এপ্রিল ছিল এই স্বদেশ চেতনায় বলিয়ান এই মহৎ ব্যক্তিটির জন্মবার্ষিকী।
শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশের কর্মজীবন মাদ্রাসার মাধ্যমে শুরু হলেও, পর্যায় ক্রমিকভাবে তিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় , কলেজ সহ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষকের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলেন । এছাড়াও তিনি রেডিও বেতারে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি ‘সাহিত্য মজলিস’ নামে একটি বাংলা সাহিত্য বিষয়ক সংগঠন গড়ে তোলেন এবং আয়ুব বিরোধী বিভিন্ন কর্মকান্ড ও আন্দোলনের সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন ফান্ড হতে অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থের যোগান দিতেন এবং বাংলাদেশ মুক্তির স্বপক্ষে প্রচার পত্রে নিয়মিত লেখালেখি।
তার লেখা উপন্যাস গুলো অধিক অন্তরে দেশভাগ ও উপনিবেশিকতাকে মূলমন্ত্র করে লেখা। তার লেখা নানাবিধ সাহিত্য রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য চচ্ছে- নীড়সন্ধানী, নিশুতি রাতের গাথা, কাব্য নদী নিঃশেষিত হলে, সমুদ্র শৃঙ্খলিতা উজ্জয়ীনা , ও বাংলাদেশের প্রথম মুক্তি প্রামাণ্য লেখ্য উপন্যাস –‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ । যা রচিত হয়েছিল ১৯৭১ সালের মার্চের গণহত্যার দলিল রূপে। স্বচক্ষে দৃশ্যমান অনুভূতিগুলো ভাষার বর্ণনায় নিজেকে উপস্থাপন করেছেন উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের মর্যাদায়। ২৫ শে মার্চের গন হত্যা থেকে শুরু করে বিজয়ে পূর্ববর্তী সময় গুলোর পূর্ব পাকিস্তানের বিভীষিকাময় দৃশ্য গুলোর লোমহর্ষক বর্ণনা রয়েছে এই বইটিতে। স্বামীর হত্যার পর তার স্ত্রীর জীবন বাজি রেখে এই উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করেন এবং প্রায়ত শহীদ আনয়ার পাশার বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার শিক্ষক ড. কাজী আব্দুল মান্নান এর সহায়তায় প্রকাশ করেন স্বাধীন বাংলার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম উপন্যাস রূপে এবং পড়ে এই উপন্যাসটি ইংরেজিতেও মুদ্রিত হয়। মৃত্যুর বহু বছর পর তাকে বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭২,মরণোত্তর) ও ২০২০ সালে ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’- রচনার জন্য তিনি মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন।
তিনি ছিলেন একজন কট্টর দেশ প্রেমিক। মুক্তিযুদ্ধে দেশ স্বাধীন ও বাংলার প্রতি ছিল দৃঢ় বিশ্বাস ও আস্থা। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার বলিষ্ঠ কলম সৈনিক। দেশ স্বাধীনতার এই মুল্য কেবল তার সীমাবদ্ধতায় ছিল না বরংচ এর মূল্য পোহাতে হয় তার এইচএসসি পড়ুয়া পুত্রকেও। ১৯৭২ সালে ভুল তথ্যের বশবর্তী হয়ে বামপন্থী রাজনীতিবিদ সন্দেহে পুলিশ তার জ্যৈষ্ঠ পুত্রকে ধরে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে সেখান থেকে ছাড়া পেলেও মেডিকেল পড়ুয়া এই মেধাবী ছাত্র পরিণত হয় এক ভায়োলেন্ট মানসিক রোগীতে। স্বাধীন দেশ থেকে এটাই ছিল তার পারিবারিক প্রাপ্তি।
আনোয়ার পাশের লেখার তৎকালীন আমলাদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। প্রথম দল যারা মুক্তিকামী ছিলেন, দ্বিতীয় দল যারা মধ্যম্পন্থা অবলম্বনকারী ও তৃতীয় দল ছিল যারা বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের বিভক্তির বিপক্ষে ছিলেন। আনোয়ার পাশার হাতে লেখা এ নির্মম সত্যগুলো হয়তো অনেক আমলা তান্ত্রিক জটিলতা ও রাজনীতিবিদদের পেশাগত ব্যক্তিগত স্বার্থে আঘাত করবে বিধায় তার প্রাপ্য শ্রদ্ধা থেকে তিনি বঞ্চিত ছিলেন বহুদিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষভাবে যা দেখেছেন তাদের সংখ্যায় গরিষ্ঠ ব্যক্তিগণ বর্তমানে জীবিত নেই। যে ব্যক্তি বর্গ জীবিত আছেন তাদের আয়ুস্কালও ক্ষীনতায় পৌঁছেছে। বাংলা মুক্তির সঠিক ইতিহাস সমুন্নত রাখতে আনোয়ার পাশা কে স্মরণ করাটা খুবই জরুরী, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য অধ্যয়ন ও অন্বেষণ করতে হলে আনোয়ার পাশা’কে অধ্যায়ন করতে হবে।