রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে  ধর্ম নিরপেক্ষতা

Oct 2, 2024 - 12:50
Oct 3, 2024 - 10:20
 0  17
রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে  ধর্ম নিরপেক্ষতা

সেকুলারিজম বা ধর্ম নিরপেক্ষতা একটি বহুমাত্রিক অভিধা। দেশ,কাল ও ব্যক্তিভেদে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণায় যথেষ্ঠ পার্থক্য রয়েছে। তবে আমার কাছে ধর্ম নিরপেক্ষতা বা সেকুলারিজম ধর্মহীনতা নয়। পৃথিবী নানা ধর্ম-বর্ণ ও মতের মানুষ থাকবে। মত, পথ ও ধর্মের বৈচিত্র্য একটি ভারসাম্যপূর্ণ জগতের অপরিহার্য বৈশিষ্ট্য বলে আধুনিক মানুষ স্বীকার করে।

সামান্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এখনও মানুষ কোন না কোন ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবী করে। তাই আমার যেমন একটি ধর্ম আছে, আপনারও একটি  ধর্ম থাকা অস্বাভাবিক নয়। আমার ধর্মের আচার আপনার ধর্মাচার থেকে ভিন্ন হতে পারে। এমনকি তা হতে পারে পরষ্পর বিপরীতও। তারপরও আপনার ধর্মটাও ধর্মই। আমার ধর্ম নিয়ে আমার অন্তরে যতটুকু আবেগ আছে, আপনার ধর্ম নিয়ে আপনারও আবেগ তার চেয়ে কম নয়।

আমি আমার ধর্মাচার পালন করি, আপনিও আপনার ধর্ম পালন করবেন। আমার ধর্মাচারে আপনি যেমন বাধা দিবেন না, আমিও আপনার ধর্মাচারে অন্তরায় সৃষ্টি করব না। আমার ধর্ম আমার কাছে যেমন শ্রেষ্ঠ, আপনিও আপনার ধর্মকে শ্রেষ্ঠ দাবী করতে পারেন। কারণ শ্রেষ্ঠত্বকে আমি কোন নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী কিংবা ধর্মের অনন্য সম্পদ বা বিশ্বাস মনে করি না। তাই ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে আমি কোন বৈরিতায় জড়াব না। আমার ধর্ম যদি সত্যিই শ্রেষ্ঠ হয়, তবে তা আপনাকে মুগ্ধ করবে, আপনাকে বিরক্ত করবে না। আপনাকে আমার শত্রুতে পরিণত করবে না। 

 আমার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব ও মানবিকতা প্রচারের অধিকার যেমন আমার আছে, তেমনি আপনার ধর্ম প্রচার ও প্রসারের অধিকারও আপনারও থাকবে। তবে আমার ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে গিয়ে আমি আপনার ধর্মকে নিকৃষ্টরূপে উপস্থাপন করতে পারি না। কারণ, ধর্মাচারে যা আছে তা কোন গোপনীয় বিষয় নয়। আমার ধর্মাচারের মাধ্যমেই আমার উৎকর্ষ ও অপকর্ষ প্রমাণিত হয়। আপনার ধর্মের অপকর্ষ প্রচারে আমার ধর্মের উৎকর্ষ প্রতিষ্ঠিত হয় না। প্রচারণার বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। কারণ আমার কাছে যদি ইঁট থাকে, আপনার কাছে যে পাটকেল নেই, তা বিশ্বাস করা নির্বুদ্ধিতা। আধুনিক মানুষের কাছে নির্বুদ্ধিতা দুরারোগ্য ব্যাধি মাত্র।

 আমার বিশ্বাসে আপনি ভ্রান্ত হতে পারেন। কিন্তু আপনার ভ্রান্তি যদি আমার পার্থিব জীবনে কোন অসুবিধার সৃষ্টি না করে, আমি বলব, আপনি আপনার ভ্রান্তি নিয়ে থাকুন। আপনার ভ্রান্তি আপনার বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত। তাই তা দূরিকরণের দায়িত্ব সৃষ্টিকর্তাই নিবেন।

কারণ, আপনার বিশ্বাসে আমি কি অভ্রান্ত? ঐশ্বরিক বিশ্বাসের অযৌক্তিকতা আমি পৃথিবীতে কিভাবে প্রমাণ করব? পারস্পরিক বিশ্বাসের কল্পিত ভ্রান্তি দূরীকরণে পেশিশক্তি তো নয়ই বরং আমি আচরণিক শক্তিও ব্যবহারে আগ্রহী নই। আপনার বিশ্বাসকে ভেঙ্গে-চুরে আমার বিশ্বাসের অনুরূপে গড়ে তোলার জন্য আমার জান-প্রাণ ছেড়ে দিতে হবে--  এরূপ যেকোনো আদর্শের সাথে আমি  কস্মিনকালেও একমত পোষণ করব না।

আধুনিক রাষ্ট্র কোন একক ধর্ম-বর্ণ, নৃতাত্ত্বিক জাতি-গোষ্ঠী বা মতের মানুষের নয়। আধুনিক রাষ্ট্র সবার জন্য। এমনকি কোন নির্দিষ্ট রাষ্ট্রের ভিতরে বসবাস না করেও মানুষ সেই রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো গ্রহণ করতে পারেন। অর্থাৎ রাষ্ট্র কেবল তার নিজেদের নাগরিকদের জন্যই নয়, অনাগরিক মানুষদের জন্যও । আধুনিক রাষ্ট্র কেবল তাদের নাগরিকদের জন্যই নয়, এ রাষ্ট্র অনাগরিকদের জন্যও সমান নিরাপদ। কারণ আধুনিক জগতে কোন রাষ্ট্রই স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারে না।  কারণ এখন গোটা পৃথিবী একটি ক্ষুদ্র গ্রামে পরিণত হয়েছে। এটাই হল গ্লোবাল ভিলেজ।

 এই গ্লোবাল ভিলেজ হচ্ছে বৈচিত্র্যময়। আধুনিক মানুষ এই বৈচিত্র্যকে ভালোবাসে, পছন্দ করে, অপরিহার্য বলে মনে করে। কারণ বৈচিত্র্যের মধ্যে মানুষের প্রকৃত প্রশান্তি ও আর্থিক সমৃদ্ধি বিদ্যমান।

অতীতে যখন এক সমাজের সাথে অন্য সমাজের সরাসরি যোগাযোগ ছিল না, তখন সমাজগুলোর মধ্যে প্রায়শই বৈরিতা লেগে থাকতো। তখন মানুষ তাদের যা আছে তাকে বড় করে দেখতো এবং অন্যদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করতো। কিন্তু বর্তমানে এক সমাজ অন্য সমাজের চেয়ে যেমন উৎকৃষ্ট নয়, তেমনি নিকৃষ্টও নয়। এক সমাজে যা ঘাটতি আছে, অন্য সমাজে  তার প্রাচুর্য রয়েছে। এই ঘাটতি-বাড়তির পারস্পরিক মিলনে গোটা পৃথিবী এখন সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখে।

রাষ্ট্র থেকে ধর্ম বা চার্চকে আলাদা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল পঞ্চদশ শতকে। ইউরোপের পোপের কর্তৃত্ব অস্বীকারের মাধ্যমে তৎকালীন রাষ্ট্র শাসকগণ এ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। রেনেসাঁর প্রভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী অনুশীলনে ইউরোপ আজ মনে করে, রাষ্ট্র শাসন আর ধর্মাচার সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। ধর্ম হল অপার্থিব ও আধ্যাত্মিক বিষয় যার স্থান ও বিস্তৃতি মানুষের মনে।

আধুনিক রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতিতে  সরকার বা শাসকগণ দায়বদ্ধ থাকে রাষ্ট্রের নাগরিকদের কাছে। কিন্তু ধর্মের দায়বদ্ধতা অদৃশ্য ঈশ্বর বা স্রষ্টার কাছে যার স্বরূপ ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে ভিন্ন ভিন্ন। ইহুদিদের ইয়াহওয়েহ বা জিহবা, ইসলামের আল্লাহ থেকে বহুলাংশে পৃথক। একইভাবে খ্রিস্টানদের ত্রিত্ববাদের সাথে হিন্দুদের বহত্ববাদের মিল খুঁজে পাওয়া মুসকিল। তাই রাষ্ট্রশাসকদের পক্ষে একই সাথে পরষ্পরবিরোধী প্রত্যাশার কোন শক্তি বা শক্তিসমূহের প্রতি কিভাবে জবাবদিহি করবেন তার সুরাহা করা সম্ভব নয়।

তাই আধুনিক জাতিরাষ্ট্র ধর্মভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে না। রাষ্ট্র ধর্ম সম্পর্কে উদাসিন না হলেও কোন নিদিষ্ট ধর্মের অনুশাসনে রাষ্ট্রের চরিত্র গঠন করতে পারে না।  এই নীতির বাস্তবায়নে প্রত্যেক সমাজ রাষ্ট্রই তাদের প্রয়োজনমত ধর্ম নিরপেক্ষ অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। ফ্রান্সের রাষ্ট্রকাঠামোতে কোনভাবেই ধর্ম রাষ্ট্র তথা জনগণের উপর শ্রেষ্ঠত্ব আরোপ করতে পারে না। বরং রাষ্ট্রই প্রয়োজনে ধর্মাচারের কিয়দংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। একই পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক।

 আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র সাংবিধানিকভাবেই কোন ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে  না। তাই তাদের ফেডারেল আইন ও নীতিতে কোন রাষ্ট্রীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মের পাঠ তো দূরের কথা ধর্মাচারের অনুপ্রেরণাও দেয়া হয় না। মানুষের ধর্মাচারের পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র ধর্ম বিষয়ে উদাসীন। এখানে ধর্ম নাগরিকদের সম্পূর্ণ নিজস্ব বিষয়। কেউ ধর্মীয় পাঠ নিতে চাইলে তাকে হয় নিজ বাড়িতে নয়তো নিজ খরচে কোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যতে হয়।

ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা বহুমতের স্বীকৃতি দেয়। এ ধারণাও তাদের দেশীয় সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত। ভারতের ধর্মগুলোকে সাধারণভাবে হিন্দুইজম বলা হলেও এদের মধ্যে বিশ্বাস ও আচারের বহুবিধ পার্থক্য রয়েছে। তাই সাংবিধানিক নির্দেশনায় ধর্ম নিরপেক্ষতা হলেও  অনেক সময় রাষ্ট্র সকল ধর্মকেই সমানভাবে উৎসাহ দিতে পারে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ধর্ম নিরপেক্ষতাও ধর্ম সম্পর্কে উদাসীন নয়। এখানেও রাষ্ট্রীয় খরচ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানে সুযোগ রয়েছে। রাষ্ট্র যদিও একটিমাত্র ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্মরূপে গ্রহণ করেছে, অন্যান্য ধর্মগুলোও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ার সম্পূর্ণ অধিকারী।

এক সময় ইউরোপে রাষ্ট্রের চেয়ে ধর্মের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ছিল অনেক বেশি। ১৬৪৮ সালের ওয়েস্টফিলিয়ার চুক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যে ধর্মনিরপেক্ষতার সূচনা হয়েছিল মানুষের সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে তার পূর্ণ প্রতিফলন ঘটতে সময়ের প্রয়োজন হয়েছিল কয়েক শত বছর। আমেরিকার ধর্মনিরপেক্ষতা ইউরোপের আদর্শকে অনুসরণ করে গড়ে উঠেছে। তাদেরও অনুশীলন চলছে তাদের স্বাধীনতার সময় থেকেই। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশ এখনও শিশু রাষ্ট্র। আমাদের স্বাধীন সত্তা অর্জনের বয়স মাত্র অর্ধ শতক। গণতন্ত্রহীনতায় আমাদের কাটাতে হয়েছে অনেক বছর। ফলে ধর্মনিরপেক্ষতা অনুশীলনের পর্যাপ্ত সময় আমরা পাইনি। আমাদের সমাজ ও ধর্ম এখনও অশিক্ষা, কুশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। তাই রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে পরিপূর্ণরূপে পৃথক করতে আমাদের যেতে হবে আরও শত বছর। 

পরিশেষে, আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা এই যে, ধর্ম থাকবে মানুষের ব্যক্তিগত পর্যায়ে। সামাজিক পর্যায়ে প্রতাশিত হোক ধর্মের মানবিক ও সার্বজনীন ঔদার্য । ধর্মপালন ও প্রচারের স্বীকৃতি আমাদের সংবিধান এ আইনের তাগিদ। কেউ যেন তার নিজের ধর্ম অন্যদের উপর চাপিয়ে না দেয়। প্রত্যেকেই তার স্ব-স্ব ধর্ম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকুক। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কের ভিত্তি হোক মানবতা। 


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। বর্তমানে ৪ এপিবিএন, বগুড়ার অধিনায়ক