রবীন্দ্রনাথ, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও বিরোধী মতের অসারতা 

Nov 28, 2024 - 20:12
Nov 29, 2024 - 18:22
 3  185
রবীন্দ্রনাথ, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত ও বিরোধী মতের অসারতা 
ছবি এডিটঃ সম্পা রানী সরকার

মাতৃভূমিকে মায়ের সাথে তুলনা করার রীতি মানুষের মজ্জাগত।পৃথিবীতে মায়ের চেয়ে বেশি ভালবাসা কোথাও যেমন পাওয়া দুষ্কর তেমনি মায়ের প্রতি সন্তানদের ভালবাসাও তুলনাহীন।মা যেমন সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে নিজের শরীরের পুষ্টি দিয়েই সন্তানের রক্ত-মাংস বৃদ্ধিতে সহায়তা করেন, তেমনি জন্মের পরেও সন্তানের অকৃত্রিম ভালবাসা ও সেবা-যত্ন দিয়ে তাকে পৃথিবীতে স্বাবলম্বী করে তোলেন। মনুষ্য সন্তান মায়ের মাধ্যমে যেমন পৃথিবীতে আসে, তেমনি জন্মের পরও মায়ের কোলেই তার পৃথিবীর জীবন শুরু হয়। এমতাবস্থায় মাকে পৃথিবীর সাথে তুলনা করার রীতি প্রাগৈতিহাসিক। পৃথিবী বা ধরিত্রী মানুষের মায়ের প্রতিরূপ। দেশ প্রেমকে মাতৃপ্রেমের সাথে এক করে দেখার প্রবণতা তাই মানুষের জন্মগত। 

প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের নিজস্ব রাজ্যের জন্য একটি পতাকা থাকত, একটি সীমানা থাকত, একটি পৃথক জাতীয়তা থাকত। আধুনিক রাষ্ট্রের একটি বাড়তি ও জরুরী পরিচয় হল তার জাতীয় সংগীত। নানা অনুষ্ঠান, আচার-উপাচার ও বহির্বিশ্বে নিজ রাষ্ট্রের অব্যক্ত পরিচয় ফুটে ওঠে মানুষের নিজ রাষ্ট্রের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি জাতীয় সংগীত। বাহ্যিক প্রতীক ছাড়াও কেবল কথা ও সুরের ভিন্নতাই একটি রাষ্ট্রকে অন্য একটি রাষ্ট্র থেকে আলাদা ভাবে শনাক্ত করা যায় তার জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে। তাই জাতীয় সংগীতহীন কোর সার্বভৌম রাষ্ট্রের অস্তিত্ব পৃথিবীতে এ মুহূর্তে নেই।

সাধারণভাবে কোন দেশের জাতীয় সঙ্গীত নির্বাচন করা হয় সেই দেশের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হওয়ার পূর্বেই। কারণ স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের শুরুতেই বাজান হয় জাতীয় সঙ্গীতের সুর। যদিও কতিপয় কৃত্রিমভাবে প্রস্তুতকৃত রাষ্ট্রে জাতীয় সঙ্গীতের নির্বাচন পরবর্তীতে হয়ে থাকে, তারপরও কোন না কোনভাবে তাদের একটি জোড়াতালীর সঙ্গীত থাকেই। এ সম্পর্কে আমরা পাকিস্তান রাষ্ট্রের উদাহরণ দিতে পারি।

১৯৪৭ সালে পাকিসস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের কোন জাতীয় সংগীত ছিল না। এক রাষ্ট্রপ্রধানের পাকিস্তান সফর উপলক্ষে যখন তাকে গার্ড অব অনার দেবার প্রশ্ন উঠল, তখন সেই রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত পাওয়া গেলেও পাকিস্তানের কোন জাতীয় সংগীত পাওয়া গেল না। তখন প্রয়োজনের খাতিরে পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিগণ একটি সুর বাজালেন। সেই সুটির অনুকরণে পরবর্তীতে একটি সংগীত রচনা হল। 

সে তুলনায় বাংলাদেশীরা অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে তাদের দেশ সার্বভৌম স্বীকৃতি পাওয়ার অর্ধশত বছর পূর্বেই তাদের জন্য রচিত হয়েছিল জাতীয় সংগীত। অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ খণ্ডিত বঙ্গ নিয়ে কোন চিন্তা করেননি। তার চিন্তা ছিল সমগ্র বাংলাকে নিয়ে। তাই ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গে তার দেশপ্রেমী মন দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। দুই বাংলাকে একত্রিত করার প্রচেষ্টা তার ছিল। এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই তিনি চালু করেছিলেন ‘রাখি বন্ধন’ এবং রচনা করেছিলেন বেশ কিছু গান ও কবিতা যেগুলো বাঙ্গালীদের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতো। তাই ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ এই গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পূর্ব থেকেই দেশপ্রেমের অনন্য সঙ্গীত হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল। 

অনেকে বলেন ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের কথা ও সুর একটি আধুনিক জাতির পক্ষে খুবই কোমল পকৃতির। তারা চান আরো দ্রততাল ও লয়ের এমন কোন সংগীত যা আধুনিক বাংলাদেশিদের নাচের তালে তালে গাওয়ার অনুপ্রেরণা দিবে। এক শ্রেণির মোল্লাদের দাবী বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম দেশে অমুসলিম রবীন্দ্রনাথের  রচিত গান জাতীয় সংগীত হতে পারে না। কিন্তু তারা বুঝতে অক্ষম যে কবি ও সুর স্রষ্টাগণ কোন নির্দিষ্ট ধর্মে আবদ্ধ নন। তাদের সৃষ্ট সাহিত্য ও সঙ্গীত ধর্মবর্ণ, দেশ-কাল ভেদে সমানভাবে গৃহীত।

বিশিষ্ট দার্শনিক ও কবি আল্লামা ইকবালের ১৯০৪ সালে রচিত ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা’ গানটি সমগ্র ভারতে এত জনপ্রিয়তা অর্জন করে যে ১৯৩০ সালে আল্লামা ইকবাল পাকিস্তান আন্দোলনের সূচনা করলে অনেকের কাছে গানটি পাকিস্তান আদর্শের বিপরীত হয়ে পড়ে। আল্লামা ইকবাল পরবর্তীতে এই গানটিতে এমন কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসেন যা ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশেরই আদর্শের সাথে মিল খায় না। কিন্তু তারপরও ভারতবাসী আল্লামা ইকবালের গানটিকে পরিত্যাগ করেনি। ভারতের নানা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান এবং দেশপ্রেমমূলক কার্যক্রমে গানটি এখনো বাজানো হয়। এমনকি এই গানের নয়টি স্তবকের মধ্যে প্রথম, তৃতীয়, চতুর্থ ও ষষ্ট স্তবক ভারতী সেনাবাহিনীর রণ-সংগীত হিসেবে এখনো ব্যবহৃত হয়। কিন্তু বিপরীত দিকে পাকিস্তানের স্বপ্নদ্রষ্টা আল্লামা ইকবালের এই গানটি পাকিস্তানিরা বেমালুম ভুলে গেছে। তাই কবি বা সঙ্গীতজ্ঞ একটি নির্দিষ্ট দেশের, একটি নির্দিষ্ট ধর্মের হতে পারে কিন্তু তার সৃষ্টিকর্ম ধর্ম-বর্ণ, দেশ-কাল নির্বিশেষে সবারই। 

আমাদের জাতীয় সংগীত বিরোধী একটি মোল্লা শ্রেণি একে হিন্দুদের কালী দেবীর বন্দনা বলে প্রচার করছে। কিন্তু বিষয়টি সর্বেবই মিথ্যা, মনগড়া ও সাম্প্রদায়িক মনোভাব-প্রসূত। মাতৃভূমিকে মায়ের সাথে তুলনা করার উদাহরণ আগেই দেয়া হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতপক্ষে প্রতিমা পূজারী ছিলেন না। ধর্মীয় দিক দিয়ে বিবেচনা করলে রবীন্দ্রনাথকে অহিন্দু বলতে হবে। কারণ তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের অন্তর্গত যারা একেশ্বরবাদী ধর্মের অনুসারী ছিলেন। রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত শান্তি নিকেতনসহ কোন প্রতিষ্ঠানেই মূর্তি পূজার স্থান নেই। 

দেশ প্রেমের গান হিসেবে রবীন্দ্রনাথ একবার বঙ্কিমচন্দ্র রচিত ‘বন্দেমাতারাম’ গানটিকে সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেন। কিন্তু তিনি দেখেন গানটির প্রথম কয়েক লাইনের পর হিন্দুদের কালী দেবীর ভক্তির বর্ণনা রয়েছে। তাই তিনি প্রথম দুই স্তবকের পর আর অনুবাদ করেননি। পরবর্তীতে ১৯৩৭ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ‘বন্দেমাতরম’ গানটিকে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত করার প্রশ্নে রবীন্দ্রনাথের পরামর্শ চাওয়া হলে রবীন্দনাথ জওহরলাল নেহরুকে লিখেছিলেন, গানটির পুরো বিষয়কে বিবেচনা করলে একে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা যাবে না। কারণ এ গানের বিষয়বস্তুকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে যা কোন মুসলমানের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হবে না।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ বলাবাহুল্য এ গানটির দুই স্তবকের পরেই কালী দেবীর পূজার প্রসঙ্গ এসেছে।

কালী দেবীর প্রসঙ্গ আছে বলেই রবীন্দ্রনাথ যখন ‘বন্দেমাতরমকে’ ভারতের জাতীয় সঙ্গীত করার পরামর্শ দেননি, সেই রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতীয় সংগীতে কালী দেবীর করেছেন বলে যারা অভিযোগ তোলেন, তারা  কেউ রবীন্দ্রনাথকেও জানেন না, সঙ্গীতও বোঝেন না এবং কালী দেবীর পূজা-পার্বন সম্পর্কেও জ্ঞান রাখেন না। আমাদের দুঃখ এখানেই যে এমন নির্বোধ লোকদের প্রচারণায় আমরা মাতামাতি করছি। 

মাতৃভূমিকে মায়ের সাথে তুলনা করে আমাদের দেশের কবি সাহিত্যিকরাও গান সংগীত ও উপন্যাস রচনা করেছেন। নজরুল তার ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতায় যখন বলেন, ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?/ কাণ্ডারী! বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা’র ‘ তখন কি তিনি তার মা জাহেদা খাতুনের কথা বলেন, না, তার জন্মভূমির কথা বলেন? তিনি জন্মভূমির বন্দনা করতে গিয়ে ‘জননী মোর জন্মভূমি’ শীর্ষক গানটি যখন লিখেন সেখানে কি তিনি কালী দেবীকে সম্বোধন করেন?

পৃথিবীতে জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার নজির ভুরিভুরি হয়েছে। কিন্তু জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করার সুনির্দিষ্ট কারণ ও জাতীয় ঐক্যমতের প্রয়োজন। যে সময়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ‘আমার সোনার বাংলাকে’ নির্বাচিত করা হয়েছিল, তখন কেউ বিরোধীতা করেছিল বলে ইতিহাসে প্রমাণ নেই। আজকে যে বিশেষ গুষ্টিগুলো জাতীয় সংগীতের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে, তাদের অনেকেই তখন জন্মগ্রহণও করেনি। অনেকের স্বাধীনতাবোধটুকুই ছিল না। যাদের স্বাধীনতাবোধ ছিল, তারা অনেকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তি ছিল। তাই বর্তমান জাতীয় সংগীত পরিবর্তন বিষয়ে রশি টানাটানি করার মত নৈতিক শক্তিও তাদের নেই। 

দেশ ও জাতি এক প্রজন্মের জন্য নয়; শত শত প্রজন্ম একটি জাতিকে ক্রমান্বয়ে গড়ে তোলে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বাংলাদেশি জাতিতে নতুন রক্ষকের সমন্বয় ঘটবে, জন্ম নেবে নুতন পথ ও মত। যদি কোন সময় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই জাতীয় সংগীত তাদের জন্য উপযোগী নয় বলে পরিবর্তন করতে চায়, সেটা অনাদী কালের ব্যাপার। কিন্তু যে জাতীয় সংগীতকে নির্বাচনকারী, নির্বাচনে সহায়তাকারী এবং এ জাতীয় সংগীতকে অন্তরে ধারণ করার মত মানুষ বা প্রজন্ম বাংলাদেশে বিরাজমান থাকবে ততদিন পর্যন্ত বর্তমান জাতীয় সংগীত অব্যহত থাকবে।


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ৪ এপিবিএন স্কুল ও কলেজ অনলাইন জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা-পৃষ্ঠপোষক, ৪ এপিবিএন, বগুড়ার সাবকে অধিনায়ক। বর্তমানে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, মিরপুর, ঢাকা এর মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ।