মারিয়া সালমেয়া স্কলদোস্কি কুরি: নোবেল বিজয়ী প্রথম নারী
আদি কালের মুনি-ঋষিগণ শাস্ত্রীয় বিধান দিতেন যে, জ্ঞান-বিজ্ঞান পুরুষের জগৎ, যেখানে নারীরা বেমানান । কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুনি-ঋষিদের ধারণা ছিল নিতান্তই মনগড়া ও নারী বিদ্বেষী। সুইডেনের রাজকীয় বিজ্ঞান একাডেমি ১৯০১ সালে থেকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অসাধারণ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার প্রদান শুরু করে। এর মাত্র তিন বছরের মাথায় পদার্থ বিজ্ঞানে যৌথভাবে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন একজন নারী বিজ্ঞানী । আরও আশ্চর্যের বিষয়, এই নারীই প্রথম একাধিক বিষয়ে দুই দুই বার নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। প্রথমবার পদার্থ বিজ্ঞানে যৌথভাবে ও পরে ১৯১১ সালে রাসায়নে এককভাবে। ভাবতেই অবাক লাগে! কি বিস্ময়কর তার মেধা, কি অক্লান্ত তার পরিশ্রম! আমরা এখন সেই নারীর গল্পই শুনব।
এই নারীর পিতৃ প্রদত্ত নাম মারিয়া সালমেয়া স্কলডোস্কি। পরবর্তী সময়ে তিনি পরিচিত হন, মেরি কুরি হিসেবে। মারিয়া স্কলডোস্কি তৎকালীন রুশ সাম্রাজ্যভুক্ত পোল্যান্ড রাজ্যের ওয়ারশ নগরীতে ১৮৬৭ সালের ৭ নভেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা ব্রনিস্লাওয়া বোগাস্কা ও মা ওলাডিশ্লো স্কলোডৌস্কির পাঁচ সন্তানের কনিষ্ঠ ছিলেন মারিয়া। ব্রনিস্লাওয়ার পরিবারের পূর্বপুরষগণ পেশায় শিক্ষক ছিলেন । পিতা ছিলেন গণিত ও পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক। মা একটি মেয়েদের বোর্ডিং স্কুল চালাতেন। পোল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা আন্দোলনে যুক্ত থাকায় মারিয়ার পিতৃ ও মাতৃকুলের সবাই সর্বস্ব হারিয়েছিলেন। মারিয়ার দশ বছর বয়সে তার মা ওলাডিশ্লো যক্ষারোগে মারা যান। মারিয়ার মা আচারনিষ্ঠ ক্যাথলিক খ্রিস্টান হলেও পিতা ছিলেন নাস্তিক।
দশ বছর বয়সে তিনি একটি বোডিং স্কুলে মারিয়ার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। পরবর্তীতে একটি সেকেন্ডারি স্কুল( জিমনেশিয়াম) থেকে গোল্ড মেডেলসহ পাশ করেন। কিন্তু ঐ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীদের উচ্চ শিক্ষার সুযোগ না। তাই প্রচলিত কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পেরে মারিয়া জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতাকামীদের গোপনে পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ( ফ্লায়িং ইউনিভার্সিটি) উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শুরু করেন ।
বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষালাভের জন্য মারিয়া তার বোন ব্রনিস্লাওয়ার সাথে এ সমঝোতা করেন যে ব্রনিস্লাওয়া প্যারিসের মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলে তিনি আর্থিক সহায়তা দিবেন। ব্রনিশ্লাওয়া পড়াশোনা শেষে রোজগার করে মারিয়ার পড়াশোনার খরচ বহন করবেন । বড় বোনের মেডিকেলের পড়াশোনার খরচ বহনের জন্য মারিয়া প্রথমে টিউশনি শুরু করেন। পরে মস্কো থেকে প্রায় আশি কিলোমিটার দূরে সেজুকি গ্রামে গিয়ে তার পিতার এক আত্মীয় জোরায়াস্কির পরিবারের গভর্নেন্সের চাকরি গ্রহণ কেরন।
কিন্তু অচিরেই জোরায়াস্কি পরিবারের যুবক কাজিমেয়ার্জ মারিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। কিন্তু মারিয়ার পরিবার দরিদ্র হওয়ায় কাজিমেয়ার্জ এর পরিবার বিয়েতে রাজি হয়নি। মারিয়াকে গভীরভাবে ভালবাসলেও পিতামাতাকে অমান্য করার শক্তি তার ছিল না। তাই মারিয়াকে বিয়ে করার সৌভাগ্য তার হয়নি। কিন্তু কাজিমেয়ার্জ মারিয়াকে কোনদিন ভুলতে পারেননি। তাই বৃদ্ধ বয়সেও মেরিকুরি স্থাপিত রেডিয়াম ইন্সটিটিউটের সামনে স্থাপিত মারিয়ার ভাস্কর্যের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতেন।
প্যারিসে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া বোন বিয়ে করে মারিয়াকে প্যারিসে ডেকে পাঠান। বোন দুলাভাইয়ের আশ্রয়ে মারিয়া ১৮৯১ সালে প্যারিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ, রাসায়ন ও গণিতে পড়াশোনা শুরু করেন। বোন দুলাভাইয়ের সহায়তা সত্ত্বেও খুবই আর্থিক কষ্টে কাটতে থাকে মারিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। তিনি দিনে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস করে, রাতে টিউশনি করতেন। দুই বছর পর পদার্থ বিজ্ঞানের ডিগ্রি নিয়ে মারিয়া প্রফেসার গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানের তত্ত্বাবধানে একটি শিল্প গবেষণাগারে চাকরি নেন। পাশাপাশি একটি ফেলোশিপের অধীন অধিকতর পড়াশোনা চালিয়ে দ্বিতীয় ডিগ্রি অর্জন করেন।
মারিয়ার বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা শুরু হয় ফ্রান্সের জাতীয় শিল্পকে উৎসাহদানের জন্য কমিশনকৃত একটি গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে। এখানে তিনি বিভিন্ন ধরনের ইস্পাতের গুণাগুন নিয়ে গবেষণা করেন। এসময় প্যারিস শিল্পবিষয়ক পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ( ইএসপিসিআই) শিক্ষক পিয়েরে কুরির সাথে তার পরিচয়। কুরি একজন গবেষক। ইতোপূর্বে তিনি ইলেকট্রমিটার নামের একটি যন্ত্রও আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি এখানে একটি ক্ষুদ্র গবেষণাগারে কাজ করতেন।
এক সময় একই প্রতিষ্ঠানে মারিয়াও কাজ করার সুযোগ লাভ করেন। ঘনিষঠবাবে কাজ করতে গিয়ে পিয়েরে মারিয়ার প্রেমে পড়ে যান। কিন্তু মারিয়া এই বলে পিয়েরেকে বিরত রাখেন যে তিনি প্যারিসে থাকবেন না। নিজ জন্মভূমি ওয়ারশতে গিয়েই জীবনের সাফল্য সন্ধান করবেন। কিন্তু পিয়েরে মারিয়াকে প্রতিশ্রুতি দেন তিনিও তার সাথে পোল্যান্ডে যাবেন যদিও সেখানে তাকে ফরাসি ভাষার শিক্ষক হিসেবে জীবনযাপন করতে হয়। অবশেষে মারিয়া রাজি হন।১৮৯৫ সালের জুলাই মাসে তারা বিয়ে করেন। তাদের বিবাহিত জীবনে দুই কন্যা আইরিন ও ইভ এর জন্ম হয়েছিল। আইরিন মায়ের সাথে গবেষণায় যুক্ত হয়ে পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালে রসায়নে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ইভ একজন চিত্রশিল্পী ও সাংবাদিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ডিসেম্বর ১৯০৩ সালে সুইডিস রয়াল একাডেমি অব সাইন্স প্রফেসার হেনরি বেকেরেলের রেডিয়েশন থিওরির উপর অসাধারণ গবেষণা কর্মের জন্য পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু এই আবিষ্কারের উপর মেরি, পিয়েরে ও বেকেরেল তিনজনই সমান কৃতীত্বের অধিকারী হলেও নোবেল কমিটি মেরিকে বাদ দিয়ে কেবল পেয়েরে ও বেকেরেলকে পুরস্কার প্রদানের পায়তারা করে। কিন্তু কমিটির অন্যতম নারীবাদী সদস্য ম্যাগনাস গোস্টা মিটেগ-লেফলার বিষয়টি গোপনে পিয়েরেকে জানিয়ে দেন। এতে পিয়েরে কমিটির কাছে অভিযোগ করেন যে এই গবেষণার পিছনে বরং মেরির অবদানই বেশি। কেবল নারী হওয়ার কারণেই তাকে বাদ দেয়া হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত নোবেল কমিটি মেরিসহ তিনজনকেই যৌথভাবে পদার্থ বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার প্রদান করেন। মেরি কুরিই হলেন পৃথিবীর প্রথম নারী নোবেল বিজয়ী।
১৯০৩ সালেই প্রফেসার গ্যাব্রিয়েল লিপম্যানের তত্ত্বাবধানে প্যরিস বিশ্ববিদ্যালয় মেরিকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেন। কুরি দম্পতিকে লন্ডনের রয়াল ইন্সটিটিউট রেডিওঅ্যাকটিভিটির উপর বক্তৃতা দেয়ার জন্য আমন্ত্রিত হন। কিন্তু নারী হওয়ার কারণে মেরিকে ইন্সটিটিউট কর্তৃপক্ষ বক্তৃতা দেয়ার অনুমতি না দিলে পিয়েরে কুরি একাই বক্তব্য রাখেন।
নোবেল পুরস্কারের অর্থ কুরি দম্পতিকে কিছুটা আর্থিক সচ্চলতা এনে দেয়। এর অর্থ দিয়ে তার প্রথমেই তাদের গবেষণাগারের জন্য একজন সহকারী নিয়োগ করেন। জেনেভা ও প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অধ্যাপকের পদ গ্রহণের অনুরোধ করেন। তবে তখন পর্যন্ত কুরি দম্পতির সুসজ্জিত কোন গবেষণাগার ছিল না। প্যারিস মেডিকেল হাসপাতালের লাশকাটা ঘরকে তারা কোনরকম সাজিয়ে গবেষণাগার হিসেবে ব্যবহার করছিলেন। অবশেষে ১৯০৬ সালে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় তাদের জন্য একটি সুসজ্জিত ল্যাবরেটরির ব্যবস্থা করেন।
১৯০৬ সালে পিয়েরে কুরি প্যারিসে রাস্তায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন। স্বামীর মৃত্যুতে মেরি অত্যন্ত মর্মাহত হন। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় নিহত পিয়েরের জন্য পদার্থ বিদ্যা বিভাগে যে পদের সৃষ্টি করেছিলেন কর্তৃপক্ষের অনুরোধে মেরি তা গ্রহণ করেন। ফলে প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই প্রথম নারী অধ্যাপকের পদ অলঙ্কৃত করেন।
স্বামীর মৃত্যুর পরও মেরির গবেষণা কার্যক্রম চলমান থাকে। ১৯১০ সালে তিনি রেডিয়াম শনাক্ত করেন। এছাড়াও তিনি রেডিও-অ্যাকটিভ বিকিরণের একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডও নির্ধারণ করেন যাকে কুরি দম্পতির সম্মানার্থে পরবর্তিতে কুরি একক হিসেবে নামকরণ করা হয়। ১৯১১ সালে মেরি কুরি ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির সদস্যপদ লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে এক কিংবা দুই ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন।
একজন বিজ্ঞানী হিসেবে প্রভূত নামডাকসহ দীর্ঘদিন ধরে ফ্রান্সে বসবাস করেও মেরি কুরিকে বিদেশি বলে ফরাসি সমাজে হেয় করা হত। ফরাসি পত্রপত্রিকা তাকে একজন ইহুদি বলে প্রচারণা চালাত। ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমির নির্বাচনে তার বিরুদ্ধে ডানপন্থিগণ একই সাথে বিদেশী ও নাস্তিকতার অভিযোগ নিয়ে এসেছিল।
১৯১১ সালে ফরাসি ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো তার স্বামীর প্রক্তনছাত্র পদার্থবিদ পল ল্যান্জেভিনের সাথে বিধবা মেরির প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে মুখরোচক খবর প্রচার করে। এ কেলেঙ্কারি থেকে তার একাডেমিক শত্রুগণ ফায়দা লুটতে শুরু করে। বেলজিয়াম থেকে বক্তৃতা শেষে বাসায় ফিরলে উত্তেজিত জনতা তাকে বাসায় ঢুকতে বাধা দেয়। তিনি পার্শ্ববর্তী কে বনধুর বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন।
পেম বিষয়ক কেলেঙ্কারির সমান্তরালে তার আন্তর্জাতিক অর্জনও বাড়তে থাকে। একই বছর রয়াল সুইডিস একাডেমি তাকে রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম নামের দুটো নূতন তেজক্রিয় মৌল আবিষ্কারে জন্য দ্বিতীয়াবেরর মতো নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করেন। প্রেম-কেলেঙ্কারির ধুয়া তুলে পুরস্কার বিতরণ কমিটি তাকে অনুষ্ঠানে বক্তব্যদান থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনের ঘটনাবলীর সাথে তার বৈজ্ঞানিক গবেষণা সম্পর্কহীন বলে মেরি তীব্র প্রতিবাদ করলেশেষ পর্যন্ত তারা তাকে বক্তব্য প্রদানের অনুমতি প্রদান করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে মেরি কুরি আহত সৈনিকদের চিকিৎসা ত্বরান্বিত করতে ভ্রাম্যমাণ এক্স-রে ল্যাবরেটরি প্রতিষ্ঠা করেন। তার ভ্রাম্যমান এক্স-রে ইউনিটে প্রায় লক্ষাধিক আহত সৈনিকের চিকিৎসা সেবা দেয়া হয়েছে।
নিজে গবেষণা করা ছাড়াও মেরি বেশ কিছু গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। দীর্ঘদিন তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে কাজ করার ফলে তার শরীরে অ্যাপ্লাস্টিক অ্যনিমিয়া নামের এক ধরনের ক্যান্সার ছড়িয়ে পড়ে। অবশেষে ১৯৩৪ সালের ৪ জুলাই ৬৬ বছর বয়সে এ মহিয়ষী নারী মৃত্যুবরণ করেন।
দারিদ্র্যের সাথে যুদ্ধ করে উচ্চ শিক্ষালাভ, বিজ্ঞানের একাধিক শাখায় অসাধারণ অবদান, নিপীড় মানবতার সেবা ও পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের কারণে মেরি কুরি আধুনিক নারীদের অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
রচনা সূত্র:
১.https://www.bigganchinta.com/feature/7v3fst1r6d
২.https://en.wikipedia.org/wiki/Marie_Curie
3.https://www.nobelprize.org/prizes/physics/1903/marie-curie/biographical/