মহাবীর খালিদ ইবনে ওয়ালিদের শেষ পরিণতি

Jul 11, 2024 - 20:05
Jul 11, 2024 - 19:34
 6  174
মহাবীর খালিদ ইবনে ওয়ালিদের শেষ পরিণতি
ছবি এঁকেছে- সামিয়া মালিহা, সপ্তম শ্রেণি, রোল-৩০, কলাবতী শাখা

 ইসলামের ইতিহাসে যে কয়জন ব্যক্তি তাদের শারীরিক ও সামরিক দক্ষতা দিয়ে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন তাদের মধ্যে খাদিল বিন ওলিদ অন্যতম। তার বীরত্ব ও সামরিক দক্ষতার জন্য খোদ মুহাম্মদ (সা) তাকে সাইফুল্লাহ বা আল্লাহর তরবারী উপাধিতে ভূষিত করেছিরেন।  খালিদের জন্ম ৫৯২ সালে মক্কার কুরাইশ বংশের মাখজুম গোত্রে । সম্পর্কের দিক দিয়ে  তিনি ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমরের (রা) এর মামাত ভাই। মুহাম্মদ (স) এর হিযরতের পূর্বে তো বটেই, এমনকি হিযরতের পরেও হুদায়বিয়ার সন্ধির পরেও তিনি মুহাম্মদের ঘোর বিরোধী ছিলেন।

 মক্কার কুরাইশদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে দক্ষ ঘোড়সওয়ার ও বর্শা নিক্ষেপকারী ছিলন। বাল্যকালে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার মুখমণ্ডলে বড় বড় ঘায়ের দাগ ছিল। হুদায়বিয়ার সন্ধির বেশ কিছু দিন পরে তিনি স্বেচ্ছায় ইসলাম গ্রহণ করেন এবং মক্কা বিজয়সহ মহানবীর(স) আমলের সকল যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেছিলেন। মুতার যুদ্ধে বাইজেন্টাইন বাহিনী কর্তৃক মুসলিম সৈন্যগণ অবরুদ্ধ হয়ে পড়লে খালিদ অভিনব কৌশলে  তাদের নিরাপদে প্রত্যাবর্তনের পথ খুঁজে বের করে সকলের বিস্ময় উদ্রেক করেন । 

 মক্কা বিজয়কালে মহানবী (স) খালিদকে মক্কার নিম্ন অঞ্চলে খোলা তরবারীসহ নিয়োগ করেন। এসময় তার হাতে কিছু নিরীহ মক্কাবাসী নিহত হয়। হযরত আবু বকরের খিলাফতের সময় কিছু আরব গোত্র সরকারি কোষাগারে যাকাত প্রেরণে অনীহা প্রকাশ করে। কেউ কেউ পূর্বের বিশ্বাসে ফিরে যায়। অনেক ভণ্ড নারী ও পুরুষ নিজেদের নবী বলে দাবী করতে শুরু করে। হযরত আবু বকর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন যা রিদ্দার যুদ্ধ নামে পরিচিত। রিদ্দার যুদ্ধে খালিদ ছিলেন সবচেয়ে সাফল্য অর্জনকারী সেনাপতি। তিনি ভণ্ড নবী তুলাইহা, সাজাহ ও  মুসাইলিমা কাজ্জাবকে হত্যা করেন। তবে রিদ্দার যুদ্ধের সময় মালিক ইবনে নুয়াইরা ও তার সহযোগীদের হত্যার ক্ষেত্রে তার কৌশল ও নির্মমতা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা সৃষ্টি হয়।

 অনেকে মনে করেন, মালিক মুরতাদ ছিল না। তাকে খালিদ ভুল বুঝে হত্যা করেছিলেন। তবে মালিককে হত্যার পর তার দুইটি কাজ অত্যন্ত বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল।  প্রথমত, তিনি মালিককে হত্যার পর তার কর্তিত মস্তকের সাথে পাথর জুড়িয়ে চুলা বানিয়ে তার উপর পাতিল বসিয়ে মাংস রান্না করে খেয়েছিলেন। মালিককে হত্যার পর তার মাথাটিকে তিনি একটি পাতিলের নিচে স্থাপন করতে বলেন। পাতিলের আর দুই দিকে দুইটি পাথর দিয়ে একটি চুলা তৈরি হলে মালিকের মাথার কর্তিত  চুলকে জ্বালানী বানিয়ে খালিদ সেই চুলায় রান্না করে সকালের  সকালের নাস্তা তৈরি করে খান। মালিকের  মাথায় এত বেশি চুল ছিল যে সেই চুল জ্বালিয়ে মাংশ রান্না করার পরও আরও চুল অবশিষ্ট ছিল।

মালিক হত্যা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি ও তার লাশ নিয়ে বাড়াবাড়ি ধরনের নিষ্ঠুরতার জন্য খালিদের অন্যতম সেনাপতি আবু কাতাদা তার সঙ্গ ত্যাগ করে মদিনায় গিয়ে খলিফা আবু বকরের নিকট অভিযোগ করেন। এ কথা শুনে হযরত ওমর খালিদকে সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করার উপদেশ দেন। কারণ তিনি মনে করতেন, খালিদ ইসলামের জন্য অনেক কিছু করলেও তার তরবারীতে জুলুম রয়েছে। কিন্তু আবু বকর এতে রাজি না হয়ে মন্তব্য করেছিলেন, খালিদ আল্লাহর তরবারী যাকে আল্লাহ নিজেই কোষমুক্ত করেছেন। তাই তাকে তিনি স্তব্ধ করতে চান না।

খালিদের দ্বিতীয় বিতর্কিত কাজটি ছিল নিহত মালিকের বিধবা স্ত্রী লায়লাকে তড়ি ঘড়ি করে বিয়ে করা। তিনি মালিককে হত্যার দিনই লায়লাকে বিয়ে করেন। এজন্য অনেকে মনে করতে থাকেন যে সুন্দরী লায়লাকে পাওয়ার জন্যই তিনি ইসলাম ত্যাগ না করা সত্ত্বেও মালিককে হত্যা করেছিলেন।

 রিদ্দার যুদ্ধ শেষ হলে খালিদকে ইরাকে শাসানিদ সম্রাটদের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। সেখানেও একের পর এক যুদ্ধে খালিদ জয়লাভ করেন। এ অভিযানের অংশ হিেসব উলাইসের যুদ্ধে খালিদ পারস্যের বাহিনীকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে দেন। তবে এখানেও তিনি এক হত্যার উৎসবে মেতে ওঠেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে এখানে তিনি পারসিকদের হত্যা করে রক্তের নদী প্রবাহিত করবেন । তিনি এখানে সত্তর হাজার পারসিক সৈন্য হত্যা করেন। নিহত পারসিকদের রক্ত জমাট বেঁধে নিকটস্থ নদীর ধারা বন্ধ হয়ে গেলে  খালিদ রক্তের উপর পানি ঢেলে দেন। এতে নদীটি পুনরায় গতিশীল হয়। তিনি তার প্রতিজ্ঞাও রক্ষা করেন।

 ইরাক থেকে খালিদকে সিরিয়া অঞ্চলে রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রেরণ করা হয়। সেখানে তিনি আবু উবায়দার সাথে মিলিত হয়ে যুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। তার বাহিনী যখন ইয়ারমুকের যুদ্ধে রোমান সৈন্যদের মুখোমুখি হয় সেই সময় প্রথম খলিফা আবু বকর ইন্তেকাল করেন। খালিদ তার সৈন্যদের কাছ থেকে খলিফার মৃত্যুর খবর গোপন রাখেন যাতে তারা হতদ্যম না হয়ে পড়ে। 

 কিন্তু নতূন  খলিফা ওমর তার দায়িত্ব গ্রহণ করার পর প্রথমেই খালিদকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে বরখাস্ত করে আবু উবায়দাকে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেন। খালিদ রয়ে গেলেন সাধারণ সেনাপতির পর্যায়ে। রিদ্দার যুদ্ধে মালিক বিন নুয়াইরাকে হত্যা, তার স্ত্রীকে তড়িঘড়ি করে বিবাহ করা, খালিদের প্রতি সাধারণ সৈন্য ও মানুষের গণ-আস্থা ইত্যাদি বিষয়ে খলিফা ওমর পূর্ব থেকেই বিরক্ত ছিলেন। তিনি চিঠিতে কিছু কিছু অভিযোগের কথা লিখে সেগুলো সম্পর্কে তার স্বীকারোক্তি গ্রহণের জন্য আবু উবায়দাকে নির্দেশ দেন। চিঠিতে লেখা ছিল, যদি এসব অভিযোগের বিষয়ে খালিদ যে কৈফিত দিয়েছিলেন তা যে মিথ্যা ছিল এ কথা যদি সে মেনে নেয় তবে সে সেনাপতি থাকবে, নয়তো তাকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে বরখাস্ত করা হবে।

 বিষয়টি খালিদের জন্য ঊভয় সংকটের সৃষ্টি করে । হযরত ওমর খালিদকে পছন্দ করেন না বলে খালিদের ঘনিষ্ঠজনরা মনে করতেন।  নিজেকে মিথ্যাবাদী রূপে স্বীকৃতি দিলে তিনি আজ হোক কাল হোক অপসারিত হবেনই।  খালিদ তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ স্বীকার করলেন না। তাই খলিফার শর্তানুসারে তিনি প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারিত হলেন।  তখন খলিফার নির্দেশ অনুসারে আবু উবায়দা খালিদের সকল সম্পদ দুইভাগে ভাগ করে একভাগ খালিদকে দিলেন এবং অপরভাগ খলিফার নিকট পাঠিয়ে দিলেন। এমনকি খালিদের দুই পায়ের দুই জুতার একটি খুলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে পাঠিয়ে দেয়া হল। তার এক পায়ে জুতো, অন্য পা খালি রইল।  তারপরও ধর্মপ্রাণ খালিদ খলিফার প্রতি পূর্ণ অনুগত থেকে একজন সাধারণ সেনাপতির দায়িত্ব নিয়ে একের পর এক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। সিরিয়া দখলের পর মুসলিম বাহিনী জেরুজালেমও দখল করে। খালিদ সাধারণ সেনাধ্যক্ষ রূপে এসব যুদ্ধেও বীরত্ব প্রকাশ করেন।

 কিন্নাসরিন নামে রোমান সাম্রাজ্যের একটি পার্বত্য এলাকায় অভিযান চালিয়ে খালিদ বিপুল পরিমাণ গণিমত লাভ করেন । এ সময় নানা দিক থেকে অনেক লোক খালিদের কাছে সাহায্যের আবেদন জানায় । খালিদ তাদের যথাসাধ্য সহায়তা করেন। আসআছ ইবনে কায়স নামের এক কবিকে খালিদ ১০ হাজার দিরহাম দান করলেন। কথিত আছে যে আশআস খালিদের বীরত্ব গাথা নিয়ে একটি বড় সড় কবিতা রচনা করেছিলে। একজন কবিবে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ দান করার বিষয়টি খলিফা ওমরের কানে গেলে তিনি খালিদের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন । তিনি হযরত বেলালের মাধ্যমে পত্র দিয়ে সেনাপতি আবু উবায়দাকে নির্দেশ দিলেন, যে তিনি খালিদের মাথার পাগড়ি খুলে সেই পাগড়ি দিয়ে খালিদকে বেঁধে ফেলে জানতে চাইবেন এই দশ হাজার দিরহাম তিনি কোন খাত থেকে কবি আসআছকে দান করলেন। যদি এটা রাজকোষ থেকে হয়, সেটা হবে রাষ্ট্রীয় সম্পদের খেয়ানত তথা দুর্নীতি আর যদি এটা তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে হয় সেটা হবে একটি বড় ধরনের অপচয় যা একজন সেনাপতি করতে পারেন না।

 খলিফার নির্দেশ সেনাপতি আবু উবায়দুল্লাহ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। খালিদ তার ওজর পেশ করলেন। কিন্তু তা আবু ওবায়দার কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় তিনি খালিদকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে খলিফার নিকট প্রেরণ করলেন। ওমরের দরবারে খালিদ কঠিনতর বিড়ম্বনার শিকার হলেন। খলিফা তাকে তার দানকৃত ১০ হাজার দিরহামের উৎস সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তা তার ব্যক্তিগত প্রাপ্য থেকে দেয়া হয়েছে বলে উত্তর দিলেন। তারপর খলিফা বললেন, আপনার সাথে যা আছে তা থেকে ৬০ হাজার দিরহামের বেশি যা হবে তা আপনাকে দেয়া হবে না। খালিদের সব মালপত্র খুলে তার মূল্য হিসেব করে সেখান থেকে ২০ হাজার দিরহাম রেখে দিয়ে খালিদকে ওমর ভবিষ্যতের জন্য সকল প্রকার সরকারি দায়িত্ব অব্যহতি দিলেন। অবসান ঘটল খালিদের সৈনিক জীবনের। এরপর তিনি আর কোন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি।


যুদ্ধ ক্ষেত্রে থেকে প্রত্যাহৃত ভগ্নহৃদয় খালিদ তখন একজন সম্পূর্ণ বেশাসমরিক লোক হিসেবে এমেশা অঞ্চলে নিভৃতে বসবাস করতে শুরু করেন। কিন্তু সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও জিহাদে অংশগ্রহণ করতে না পারার যন্ত্রণা তাকে দগ্ধ করতে থাকে। কারণ, খালিদের বাসনা ছিল  ধর্ম যুদ্ধ করে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেই শহীদ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাকে শহীদের মর্যাদা দিতে চাননি। তাই তিনি বলতেন, “ আমি শাহাদাতের ইচ্ছা নিয়ে এত বেশি যুদ্ধে লড়াই করেছি যে আমার শরীরের কোনো অংশ ক্ষতচিহ্নবিহীন নেই যা বর্শা বা তলোয়ারের কারণে হয় নি। এরপরেও আমি এখানে, বিছানায় পড়ে একটি বৃদ্ধ উটের মতো মারা যাচ্ছি। কাপুরুষদের চোখ যাতে কখনো শান্তি না পায়। কিন্তু খালিদের স্ত্রী তাকে শান্তনা দিয়ে বলতেন, "আপনাকে ‘আল্লাহর তলোয়ার’ উপাধি দেওয়া হয়েছে। অথচ ‘আল্লাহর তলোয়ার’ কখনও ভাঙতে পারে না। তাই আপনি শহিদ হিসেবে নয় বরং বিজয়ী হিসেবে মৃত্যুবরণ করবেন। 

ইসলাম গ্রহণের পর থেকে খালিদ সৈন্যবাহিনী থেকে অব্যহতি পাওয়া পর্যন্ত খালিদ একশতটিরও বেশি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কোন যুদ্ধেই তিনি পরাজিত হননি। পৃথিবীর ইতিহাসে চেঙ্গিসখান ভিন্ন অন্য কোন যোদ্ধা তার সমকক্ষ ছিলেন না। কিন্তু তার সেষ জীবন বড় অপমানের সাথে অতিবাহিত করতে হয়েছে।

তথ্য সূত্র: ( আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, আল্লামা ইবনে কাসির, অনুবাদ ইসলামী ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৫১)


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। বর্তমানে ৪ এপিবিএন, বগুড়ার অধিনায়ক