মহাবিশ্বের মৃত্যু: ব্ল্যাক হোলও বিলিন হবে এক দিন

Sep 5, 2024 - 09:07
Sep 5, 2024 - 21:06
 0  25
মহাবিশ্বের মৃত্যু: ব্ল্যাক হোলও বিলিন হবে এক দিন

মহাসম্প্রসারণ তত্ত্বানুসারে,  সৃষ্টির সূচনালগ্নে মহাবিশ্বের সকল বস্তুই অসীম ঘনত্ব বিশিষ্ট একটি বিন্দুতে একীভূত ছিল। প্রায় ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে একটি বৃহৎ বিষ্ফোরণের মাধ্যমে আমাদের মহাবিশ্ব সৃষ্টির সূচনা হয়েছিল। মহাবিশ্ব সৃষ্টির সাথে সাথেই সূচনা হয় সময়ের। সময়ের পর সৃষ্টি হয় শক্তির। শক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয় বস্তুর। মহাবিষ্ফোরণের পর থেকেই মহাবিশ্ব অসম্ভব গতিতে বিস্তৃত হতে থাকে যা চলতে থাকবে অনন্তকাল।

সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায়ে মহাবিশ্বের শক্তিগুলো জন্ম দেয় মৌলিক কণিকাগুলোর। এসব কণিকা পরস্পর একত্রিত হয় তৈরি করে তারকারাজি। বিলিয়ন বিলিয়ন তারকার সমন্বয়ে গঠিত হয় গ্যালাক্সি। এই গ্যালাক্সিগুলোও চলমান। একটি অন্যটি থেকে দূরে যেতে থাকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে।

গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে কিছু কিছু তারকা থাকে নিশ্চল। কিন্তু কিছু তারকা নিজের অক্ষের উপর ঘুরতে থাকে। কিছু কিছু তারকার চারদিকে ঘুরতে থাকে আরও কিছু মহাজাগতিক বস্তু যাদের বলা হয় গ্রহ। কিছু গ্রহকে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে আরও কিছু বস্তু যাদের আমরা বলি উপগ্রহ। এই গ্রহ-উপগহগুলোর বাইরেও অনেক বস্তু রয়েছে যাদের অধিকাংশরই নিজস্ব কোন গতিপথ নেই। এরা ঘুরে বেড়ায় বিচ্ছিন্নভাবে। অনেক সময় এরা অন্যান্য বস্তুর সাথে সংঘর্ষে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এভাবেই চলতে থাকে মহাবিশ্বের বিবর্তন। কিন্তু এ বিবর্তন কতদিন চলবে? এক সময় কি সব কিছুর ধ্বংস হবে না? অবশ্যই হবে। 

মহাবিশ্ব ধ্বংসের প্রক্রিয়া সম্পর্কে দুটো বৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রচলিত আছে । একদল বিজ্ঞানী মনে করেন, মহাবিষ্ফরণের পর থেকেই মহাবিশ্বের যে বিস্তৃতি শুরু হয়েছে তা আর বন্ধ হবে না। অর্থাৎ মহাজাগতিক বস্তুগুলোর ধ্বংস হলেও মহাবিশ্বের বিস্তৃতি অনন্তকাল ধরে চলতেই থাকবে। মহাবিশ্ব সংক্রান্ত এ মতবাদকে বলা হয়েছে ‘উন্মুক্ত মহাবিশ্ব’ তত্ত্ব।

উন্মুক্ত মহাবিশ্ব তত্ত্ব মতে, মহাবিশ্বের ধ্বংস মানে, মহাজাগতিক বস্তু তথা তারকারাজির মৃত্যু। কারণ এ তারকারাজির মাধ্যমেই পৃথিবীর মত গ্রহ উপগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। এসব গ্রহেই হয়তো গড়ে উঠেছে মানব সভ্যতা। তাই তারকারাজির (যেমন সূর্যের) ধ্বংস মানেই পৃথিবীসহ গোটা সৌরজগতের ধ্বংস।

পদার্থ বিজ্ঞানের নিয়মানুসারেই তারকারিজির জন্ম হয়, বিস্তৃতি ঘটে ও এক সময় মৃত্যু ঘটে। কিন্তু মহাবিশ্ব সম্প্রসারণের এক পর্যায়ে মহাজগতে আর নূতন কোন তারকা তৈরি হতে পারবে না। কারণ এ সময় মহাবিশ্বের গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যকার দূরত্ব এতটা বেড়ে যাবে যে সেখানে অসীম শূন্যে থাকা মৌলিক বস্তুসমূহ একে অপরের সাথে এসে একত্রিত হতে পারবে না। তাই নূতন কোন মহাজাগতিক বস্তু, তারকারাজি তথা গ্যালাক্সির জন্ম হবে  না। অন্য দিকে ইতোমধ্যে জন্ম নেয়া তারকারাজি মরে যেতে থাকবে।

আমরা জানি একটি তারার জ্বালানী নিঃশেষ হলে সেই তারার তিনটি অবস্থায় নিপতিত হয়। চন্দ্রশেখরের সূত্রানুসারে কোন তারার ভর সূর্যের ভরের তিনগুণ বা বেশি হলে তারা পরিণত হয় ব্লাকহোলে। কিন্তু এর চেয়ে কম ভরের তারকাগুলো, বিশেষ করে, সূর্যের ভরের সমান ভরের তারকাগুলো জ্বালানি হারিয়ে সাদা রঙ্গের বস্তুতে পরিণত হবে যাকে বলা হয় হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেতবামন। অন্যদিকে সূর্যের ভরের চেয়ে কম ভরের তারকাগুলো জ্বালানী হারিয়ে কালো রঙ ধারণ করবে যাদের বলা হয় ‘নিউট্রন স্টার’ বা ‘কৃঞ্চ বামন’।

 উপরের আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, তারকারাজির জ্বালানী শেষ হলে গ্যালাক্সিগুলোর ভিতরে পাওয়া যাবে ব্ল্যাকহোল, শ্বেতবামন, নিউট্রন স্টার ও আরও কিছু মহাজাগতিক ক্ষুদ্রাকার মৃত বস্তু। এখন প্রশ্ন হল গ্যালাক্সির অভ্যন্তরের এসব বস্তু কি চিরকাল এভাবেই থাকবে, না, এগুলোতে আরও কোন পরিবর্তন আসবে?

পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রগুলো প্রয়োগ করে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন,  গ্যালাক্সিসমূহ থেকে এক সময় তাদের ভিতরের মৃত বস্তুসমূহ বাইরে নিক্ষিপ্ত হবে । তারকাসমূহের মৃত্যুর ১০১৮   থেকে ১০২৭  বছর পর গ্যালাক্সি থেকে ব্ল্যাকহোল ছাড়া অন্যান্য বস্তু বাইরে নিক্ষিপ্ত হবে। এবার সকল ব্ল্যাকহোল একত্রিত হয়ে একটি বৃহত্তর ব্ল্যাকহোল গঠিত হবে। প্রায় এক বিলিয়ন সৌরভরের সমান ভরযুক্ত এ ব্ল্যাকহোলকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘গ্যালাক্টিক ব্ল্যাকহোল’।

এখানে আরও একটি বাড়তি প্রশ্নের উদ্রেক হয়।গ্যালাক্টিক ব্ল্যাকহোলসমূহের শেষ পরিণতি কি হবে? এগুলো কি এ অবস্থায় থাকবে, না এদেরও মৃত্যু ঘটবে?। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ব্ল্যাক হোলসমূহ রেডিশন ছড়াতে থাকবে যার ফলে তাদের ভর কমতে শুরু করবে এবং ভর কমতে কমতে এক সময় অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। সৌরভরের সমান একটি ব্ল্যাক হোলের নিশ্চিহ্ন হতে প্রায় ১০৬৫ বছর সময় লাগবে এবং  গ্যালাক্টিক ব্ল্যাকহোল গুলোও ১০৯০  বছরের মধ্যেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। 

অনেক সময় অনেকগুলো গ্যালাক্টিক ব্ল্যাক হোলের সমন্বয়ে  তৈরি হতে পারে ‘সুপার ব্ল্যাকহোল’। সুপার গ্যালাক্টিক ব্ল্যাকহোলগুলোও এভাবে ভর হারাতে হারাতে ১০১০০ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। 

এসময় মহাবিশ্বে গ্যালাক্সিগুলো থেকে বাইরে নিক্ষিপ্ত হওয়া স্বেতবামন, নিউট্রন স্টার ও অন্যান্য ক্ষুদ্রাকার কিছু বস্তু অবশিষ্ট থাকবে যারা বিচ্ছিন্নভাবে নিয়ত বর্ধমান  অন্ধকারাচ্ছন্ন মহাশূন্যে ঘুরে বেড়াবে। 

এখন প্রশ্ন হল, নিউট্রন স্টার, শ্বেতবামন ও অন্যান্য ক্ষুদ্রাকৃতির একক বস্তুগুলো কতদিন এভাবে ঘুরে বেড়াবে? এ ক্ষেত্রে নানাবিধ প্রস্তাবনা রয়েছে যাদের একটি হতে পারে যে, এসব পরষ্পর বিচ্ছিন্ন বস্তুও এক সময় ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়ে শেষ পর্যন্ত বিকিরণের মাধ্যমে শূন্যে মিলিয়ে যাবে যার জন্য হয়তো  ১০(১০)৭৬ বছর সময়ের প্রয়োজন হবে।                           

মহাবিশ্বের শেষ পরিণতির অন্য প্রস্তাবনাটিতে মনে করা হয়, মহাবিশ্ব ক্রম সম্প্রসারণশীল হলেও তার প্রসারণের একটি শেষ সীমা রয়েছে। ৪০ থেকে ৫০ বিলিয়ন বছর পরে সম্প্রসারণ সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছিবে। তখন গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যবর্তী দূরত্ব বর্তমান অবস্থার দ্বিগুণ হয়ে পড়বে। ৯০ থেকে ১১০ বিলিয়ন বছর পরে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ও ঘনত্ব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পড়বে। তখন সম্প্রসারণের বিপরীত প্রক্রিয়া শুরু হবে যাকে বলা হবে ‘মহাসংকোচন বা ‘বিগ ক্র্যাঞ্চ’। এসময় মহাবিশ্বের সস্তুসকল পুনরায় একটি বিন্দুর দিকে অগ্রসর হতে থাকবে। এ অবস্থায় মহাবিশ্বের কোন জীবেরই বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। মহাসম্প্রসারণ বা মহাসংকোচনের পর কি হবে তা জানা সম্ভব নয় বলে বর্তমানের বৈজ্ঞানিক প্রস্তাবনা বা তত্ত্বগুলো মনে করে।।


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। বর্তমানে ৪ এপিবিএন, বগুড়ার অধিনায়ক