বেদনাভিসার
বেদনাভিসার
আশ্বিন কার্তিক মাসে বেশিরভাগ কৃষক পরিবারে ভাতের অভাব। শুধু জলি ধানে পরিবারের দশ-বারোজন সদস্যের আহার জোগাতে হিমশিম খায় রইস উদ্দিন। রাতে খাবারের পরে অতিরিক্ত দুধভাত খাওয়ার প্রথা নিষিদ্ধ তার বাড়িতে। রশিদা বেগমও সঞ্চয়ী চিন্তা থেকে মুষ্টি চাল জমা করে মাটির ডাবরে। এভাবে তেল,নুন, মসলা তুলে রাখে নিজের চোখের আড়ালে।ছেলে মেয়ের থালাতেও একমুঠো ভাত কম দেয়,আর ছালনে একটু ঝাল বেশি দেয় যাতে পানি খেয়ে পেটের এক কর্নারের খাবার বেঁচে যায়। শেষে হাঁড়ি মুছে এক আধটু যা পায়,তাই নিজে খায় অভিযোগহীন।যারা নিজের জমিতে চাষ করে তারাই অস্তিত্ব সংকটে,আর যারা বর্গাচাষি কিংবা অন্যের জমিতে খাটে তাদের ভাতের কষ্ট অবর্ণনীয়।
বিজ্ঞান যখন রহস্যঘোমটার আড়ালে ল্যাবে বন্দি,জগৎ অনুসন্ধান যখন ভাবনার টানাপোড়েনে, দারিদ্র্য বিমোচন উদ্যোগ যখন বই-পুস্তকে সীমাবদ্ধ,মাঠগুলো যখন বন্ধ্যা, বহুজাতিক ধান নারীরা যখন আসন্ন গবেষণায়,পরাগী পতঙ্গ যখন খাদ্য সংকটে ... তখন পানিকচুর জংলা শরীর হ্যাশা দিয়ে ঝুরে নিপুণ শিল্পে রূপ দেয় রইচ উদ্দিন।ভারশিকা সাজিয়ে পায়ে হেঁটে যায় দূরের কোলা, জয়পুর, আক্কেলপুর হাটে। কখনও পেঁয়াজের পুল,ধান চারা,কিংবা লাল পাটনা আলুবীজ থরে থরে সাজিয়ে বহুদূর মাইল মাইল পথ দৌড়ে যায় মাতাজী,নজীপুর,মদল হাটে।রাত দুটা আড়াইটায় রওনা দিয়ে সকালের হাট ধরে।ভারি বোঝা কাঁধে নিয়ে ধনুকের মত পিঠ বাঁকিয়ে দৌড়ে চলে অন্ধকার অভিসারীর মত। প্রয়োজনে কাঁধ পরিবর্তন করে। সাথে আরও তিন-চার প্রতিবেশী।
জঠর আগুন নিয়ে কষ্টে জন্মানো শস্যভ্রুণ ছড়িয়ে দেয় দূর দিগন্তের রুক্ষ মাঠে। পুষ্ট শরীর নিয়ে আবারো হবে বীর্যবতী ! প্রজননচক্রে ছড়াবে সবুজ সুখ,খালি হাঁড়ি পূর্ণ হবে মুঠো মুঠো সোনা চালে।ভাপ উঠা ভাতের আনন্দে সন্তানের হাসিমুখ..
এ স্বপ্ন বহুকাল ধরে বহুরঙে ভেসে বেড়ায় পৃথিবীতে। হাজারো রইচ উদ্দিন মাটি থেকে,জন্ম থেকে, কুটির থেকে, রাস্তা থেকে নগ্ন পায়ে উঠে দাঁড়ায় ভারবোঝা কাঁধে...চলে পৃথিবীর বৃহৎ নীরব বেদনাভিসার!
ভারবিহীন ফেরার পথে খায় পরাটা আর ফ্রি ডাল। পেটে যুগের ক্ষুধা! চাইলে খেতে পারবে দু-তিন দোকানীর বৃত্তা সার্কেলী সব পরাটা !নেই সামর্থ কিংবা লোভ।ভাসে অভুক্ত সন্তানের মুখ। কমদামে কিনে মোটা মাল্টিকালার গন্ধযুক্ত চাল, রিলিফের চালের মত। সমস্যা কী? ক্ষুধা মিটবে।
ক্লান্ত শরীরে হাঁটে দ্রুত, তবু পথ শেষ হয় না। মনে হয় অজস্র দিন হেঁটেও এ পথ শেষ হবে না। সেই অশেষ পথের বিস্ময় মাত্র কয়েক ঘন্টায় কী করে পাড়ি দিয়েছিল নিস্তেজ রাতে! উত্তর মেলে না।অসমান উঁচু নিচু রাস্তায় ব্যালেন্স রাখতে পা ফেটে রক্ত ঝরে। রক্তচিহ্ন পথে চলে আগত আর অনাগত প্রজন্মকে টিকে রাখার লড়াই।
একদিন তের বছরী মেয়ের সম্বন্ধ আসে। মোটা ভাত মোটা কাপড়।রাজি হয় রইচ উদ্দিন। বিয়ের খরচ আর জামাইকে কিছু টাকা, উপহার--। কূলকিনারাহীন ভাবনার অবসান হয় ইটাভাটির লাল-সবুজ শাক,পটল,মরিচ,পাটলাবণ্যে আবৃতা,অন্নপূর্ণা প্রিয় জমিটি...ঠিক হয় চৌদ্দ হাজার টাকায়।
শুভদিনে বালিকা মেয়েটি লাল শাড়ি পড়ে গরুর গাড়িতে অচিন বাড়ি চলে আর রইচ উদ্দিনকে ঘিরে একদল খাদ্যভোগী বিষণ্ন মনে দাঁড়িয়ে..
হঠাৎ বুকে হাত চেপে বসে পড়ে রইচ উদ্দিন। নির্বাক লক্ষ্যহীন দৃষ্টিচোখ ভেজা! কীসের বেদনা ! বোঝা যায় না...