বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের রিকসা চালনা ও আমাদের উচ্চ শিক্ষা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে অধ্যয়নরত এক ছাত্র রিকসা চালিয়ে পড়াশোনার খরচ যোগাড় করছেন-- এমন একটি সংবাদ সোসাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে। নেটিজেনরা হায়, হায় করছেন। কেউ কেউ এই যুবককে ১৮ কোটি বাংলাদেশির গর্ব বলে দাবী করছেন। রাজশাহী শহরে টিউশনির মূল্য খুবই কম বলে টিউশনে ছেড়ে ঢাকায় এসে রিকসা চালিয়ে তিনি ভাল পয়সা রোজগার করছে।।
তরুণটির জন্য আমারও মায়া হয়। টিউশনির টাকায় সে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে এখন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনে রিকসা চালকের বৃত্তি গ্রহণ করেছে। একই সাথে আমার ক্ষোভ হয় দেশের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার উপর। প্রায় বাইশ-তেইশ বছর ধরে আমরা তাকে উচ্চ শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু পেটের ভাত উপার্জনের জন্য কোন দক্ষতা দিতে পারিনি। তাই অর্থ উপার্জনের জন্য তিনি যে পেশা গ্রহণ করেছেন তা নিতান্ত অশিক্ষিত, অদক্ষ মানুষের।
তরুণ-যুবকদের ঢালাওভাবে উচ্চশিক্ষায় সহায়, সম্পদ ও সময় বিনিয়োগের আমি ঘোর বিরোধী । শিক্ষা অবশ্যই মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু তাই বলে উচ্চ শিক্ষা নাগরিকদের সাধারণ অধিকার নয়। বাংলাদেশে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত নাগরিকদের শিক্ষার্জন বাধ্যতামূলক। অষ্টমের পর নবম দশম এমনকি দ্বাদশ পর্যন্ত সরকারের উদার বিনিয়োগ রয়েছে। আমি মনে করি সেটা থাকা দরকার।
কিন্তু দ্বাদশ শ্রেণির পরে সাধারণ শিক্ষা বিস্তারে সরকারের উদার হওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং সাধারণ ও স্বল্প মেধার নাগরিকদের জন্য দ্বাদশ শ্রেণির পরবর্তী শিক্ষাকে নিরুৎসাহিত করার প্রয়োজন আছে। অথচ বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায়, গড়ের চেয়েও নিম্ন মেধার ছাত্রছাত্রীগণ উচ্চ শিক্ষার দিকে ধাবিত হচেছ। টেকনিক্যাল লাইনে মেধাবীদের যাচাই বাছাই করে ভর্তি করা হয়। তাই সেখানে মেধার জোরে টিকনে না পেরে সবাই ছুটছে সাধারণ শিক্ষার পিছনে। পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে এখন এমএ, বিএ, এমএসসি, এম কমের ছড়াছড়ি। তাদের সাধারণ ভাগ্য হল বেকারত্ব কিংবা ছদ্ম বেকারত্ব।
আমার বিবেচনায়, উচ্চ শিক্ষার প্রধান শর্ত হবে মেধা। দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত যারা নিরবচ্ছিন্ন মেধার পরিচয় ঘটাতে পারবে কেবল তাদেরই উচ্চ শিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা হবে খুবই সীমিত। কোন ক্লাসেই ৫০ জনের বেশি ছাত্রছাত্রীকে ভর্তি করানো হবে না।
উচ্চ শিক্ষিতরা হবে প্রকৃতপক্ষেই পণ্ডিত। তাদের একটি অংশ দেশ পরিচালনা, বিশেষ করে আমলাতন্ত্র ও প্রশাসন যন্ত্র চালু রাখবেন, নীতি নির্ধারণ, পরিকল্পনা গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারকে সহায়তা করবেন। উচ্চ শিক্ষিত মেধাবীদের একটি বড় অংশ শিক্ষা ও গবেষণায় মনোনিবেশ করবে। উচ্চ শিক্ষার অবকাঠামো নির্মাণে সরকারকে কৃপণ হলে চলবে না। তবে পাড়ায় পাড়ায় মাদ্রাসা-মসজিদ নির্মাণের মতো জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কোন কারণ নেই। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে এ মুহূর্তেও বাংলাদেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যে কেউ প্রচলিত যানবাহন ব্যবহার করেই দিনে দিনেই পৌঁছিতে পারেন। তাই দেশের বিভাগীয় শহরগুলোর বাইরে অন্য কোন শহরে নূতন করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দরকার পড়ে না।
উচ্চ শিক্ষা অবশ্যই ব্যয়বহুল হবে। যাদের মেধা ও অর্থবল আছে তারা নিজ অর্থ ব্যয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করবেন। তবে এটা যাতে কেবল বিত্তবানদের একচেটিয়া অধিকারে চলে না যায় তার জন্য সরকারকে দরিদ্র ও মেধাবীদের জন্য স্বল্পমূল্যে বা বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ করতে হবে। এর ফলে মেধাবীরা দরিদ্র হলেও উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হবে না। তারা মেধার জোরেই রাষ্ট্র পরিচালনা, নীতি নির্ধারণ ও গবেষণার মাধ্যমে নূতন নূতন জ্ঞান সৃষ্টিতে অবদান রাখবে।
সামর্থ্যবান মেধাবীদের নিজ অর্থ ব্যয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। তাদের টিউশন ফি, সেসন ফি ও উন্নয়ন ফি দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হবে। দরিদ্র মেধাবীদের জন্য সরকার ভর্তুকি দিবে, কিন্তু ধনীদের জন্য কোন ভুর্তকী থাকবে না। এ ক্ষেত্রে ধনী-দরিদ্রের একটি কার্যকর সংজ্ঞা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
বিশ্ববিদ্যালয় কেবল সার্টিফিকেট বিতরণের কারখানা না হয়ে জ্ঞান বিতরণ, জ্ঞান চর্চা ও জ্ঞান সৃষ্টির প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সমস্যাবলী চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানের পথ নির্দেশ করাই হবে গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। তবে এর বাইরেও মানব জীবন মৌলিক সমস্যা ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে। গবেষণার জন্য সরকার উদারভাবে অর্থ বিনিয়োগ করবে। সোসাল রেসপন্সিবিলিটর অংশ হিসেবে দেশের কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো্ গবেষণা খাতে অর্থ বরাদ্দ করবে।
উচ্চমাধ্যমিক পাশের পর দেশের তরুণদের বড় অংশ চলে যাবে প্রচলিত কর্মক্ষেত্রে। শিক্ষা কারিকুলামে তাদের কারিগরী জ্ঞান বিতরণ করতে হবে। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে কারিগরী শিক্ষার উপর তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এসব টেকনিক্যাল কলেজে মোটরযান ড্রাইভিং, মোটরযান ম্যাকানিক, কৃষিকাজের উপর মাধ্যমিক স্তরের জ্ঞান প্রদান করতে হবে।
দেশের তথ্য প্রযুক্তিতে ইতোমধ্যেই একটি ছোটখাট বিপ্লব ঘটেছে । একটিমাত্র ল্যাপটপ ব্যবহার করে অনলাইনে কোর্স করে অনেক কিশোর-তরুণও ফ্রিলাঞ্চিং এর মাধ্যমে লক্ষ টাকা উপার্জন করছে। অথচ অনেক বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করা তরুণ-তরুণী কম্পিউটারে একটি চিঠি পর্যন্ত টাইপ করতে পারে না। গ্রামেগঞ্জে গড়ে ওঠা ইন্টামেডিয়েট ও ডিগ্রি কলেজগুলোকে তাই ক্রমান্বয়ে তথ্য প্রযুক্তির প্রাথমিক ও মাধ্যমিক জ্ঞান প্রদানের উপযোগী করে রূপান্তিরিত করতে হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরাল হওয়া ছাত্রটি ইতোমধ্যেই স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে মাস্টার্সে পড়ছে। এত বড় ডিগ্রি নেয়ার পরেও তার জীবিকা অর্জনের কোন দক্ষতা অর্জিত হয়নি। তাই বাসায় গিয়ে ছাত্র পড়ানোর আর রিকসা চালনাকেই তার বেছে নিতে হয়েছে। অথচ এই বয়সে, এত বেশি শিক্ষা নিয়ে তার জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার মতো ট্যাকনিক্যাল ও প্রফেশনাল জ্ঞান থাকার দরকার ছিল। সে হতে পারত একজন প্রোগ্রামার, হতে পারত একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার, একজন উদোক্ততা এবং নিম্নতম হলেও একজন টেক্সি ড্রাইভার। কিন্তু এসবের কোন দক্ষতাই তার নাই। তাই সে অশিক্ষিত ও অদক্ষ মানুষদের আটপৌরে পেশায় ভাগ বসিয়েছে। এমন উচ্চ শিক্ষিত অপদার্থ দিয়ে কিভাবে চলবে দুই হাজার একচল্লিশ সালের বাংলাদেশ?