বাংলা কথাসাহিত্যে স্মরণীয় রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

Dec 5, 2024 - 19:20
Dec 8, 2024 - 14:35
 0  18
বাংলা কথাসাহিত্যে স্মরণীয় রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

গত ১৩সেপ্টেম্বর ২০২৪ কালের প্রবাহে অতিক্রান্ত। মৃত্যুর প্রায়-৫০বছর পেরিয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত ছোটগল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্রের। প্রায় নীরবে নিভৃতে চলে গেলো কত বছর। দিন সংখ্যা গণনা করলে তাঁর মহাপ্রয়াণ একেবারে কম দিন নয়। জগতে কৃতীমান মানুষেরা পৃথিবী ছেড়ে চলে যান কিন্তু পেছনে পড়ে থাকে তাঁদের কৃতি। সেই অসামান্য সৃষ্টি সরণি সামনে রেখে পরবর্তী প্রজন্ম চলার এবং উপরে ওঠার দিশা পায়। ফলে আলোকিত পূর্বসূরিদের আলোচনা নতুন প্রজন্মের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। পৃথিবীর সফল মানুষ তাই আমাদের প্রাত্যহিক পথ চেনার বাতিঘর হয়ে ওঠেন। বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় নরেন্দ্রনাথ মিত্র একজন সফল কথানির্মাতা,যাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসে অবগাহন আমাদের প্রয়োজনে তাই একান্ত অপরিহার্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য মানবিক অনুভূতিতে দ্যুতিমান এই লেখককে নিয়ে এপার কী ওপার বাংলায় তেমন কেনো আয়োজন চোখে পড়েনা বললেই চলে। অবশ্য আয়োজনের ঘনঘটা কী আকার পেল আর না পেল সেটা বড় কথা নয়। বরং বিপুল পরিমাণ গল্প,উপন্যাস ও প্রবন্ধে তিনি কতখানি প্রাতিস্বিক তাই বিবেচনার বিষয়।

নরেন্দ্রনাথ মিত্র ৪০-এর দশকের গল্পকার। তিনি ১৯১৬ সনে অবিভক্ত বাঙলার ফরিদপুরের ভাঙা থানায় জন্ম গ্রহণ করেন। এই মহান মানুষটি যে সময় গল্পের জগতে প্রবেশ করেন তখন বাংলার আকাশ ছিলো অসংখ্য ঘটনার বিষবাষ্পে উত্তপ্ত। ‘মোরা একবৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/মুসলিম তার নয়নমণি হিন্দু তার প্রাণ’ অভিন্ন এই সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পর। এরপর বাংলার আকাশে ঘটে চলে একের পর এক অস্বাভাবিক ঘটনা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দোলায় প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সমাজ,রাষ্ট্র ও মানবিকতা। সাহিত্যধারায় বাংলা ছোটগল্পের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথের প্রভাব উত্তরণে কল্লোলীয় লেখকরা তখন মাতোয়ারা। এ দলে যুক্ত হন মার্কসবাদী ঘরানার লেখকগণ। সকলের চেতনায় আলোড়ন তোলে ফ্রয়েডীয় ধারণা। এক কথায় বিশ্বসাহিত্যের বিষয় ও প্রকরণ নিয়ে শুরু হয় বাংলা সাহিত্যের নিরীক্ষা। ঠিক সে সময়ে বাংলার মানুষের ভাগ্যে সব থেকে বড় দুর্ঘটনা ঘটে। ১৯৩৫-এর ভারত শাসন আইনের কূটচালে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চিরদিনের বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৩৯ সনের বিশ্বযুদ্ধ ভারতবর্ষে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ঔপনিবেশিক শাসকদের অবহেলা আর তৎকালীন বাঙলা সরকারের ব্যর্থতায় ১৯৪৩ সনে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। খাদ্যের অভাবে মারা যায় প্রায় ৩৫ লক্ষ মানুষ। ঠিক পরের বছর ১৯৪৪ সনে দেখা দেয় বস্ত্রসংকট। অন্ন ও বস্ত্রের অভাবে দিশাহারা হয়ে পড়ে মানুষ। ১৯৪৫-এর যুদ্ধ শেষ হলে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের গতি বাড়ে। কিন্তু মানুষের জীবনে ১৯৪৬ সনে আবার নেমে আসে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার মত আর একটি মারাত্মক বিপর্যয়। 

এ বিপর্যয়ের মধ্যেই ঘটে ৪৭ সালে দেশভাগ। যুদ্ধ মন্বন্তর, দাঙ্গা ও দেশভাগের অভিশাপে মানুষের পারিবারিক ও ব্যক্তিজীবনে দেখা দেয় গভীর যন্ত্রণা ও নৈরাজ্য। সোজাকথায় ‘ব্যক্তি,পরিবার ও সমাজজীবনে প্রচলিত বিশ্বাস,ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবোধ বিনষ্টির ক্ষেত্রে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামক ঝড়ের পর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্লাবন তার সবটুকুকে শিকড়সমেত উপড়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।’ (সৈয়দ আজিজুল হক)। ছেচল্লিশ ও সাতচল্লিশ উত্তর সময়ে এপার-ওপার বাংলার প্রায় এককোটি পনের লক্ষ মানুষ জীবনের নিরাপত্তা আর অজানা ভয়ে পূর্ব-পশ্চিমে ছুটতে থাকে। ঘরহারা মানুষগুলো চোখের নিমিষে অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক জীবনে হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। দেশভাগের অভিঘাতে ছিন্নমূল মানুষে ভরে যায় কলকাতাসহ তার আশে-পাশের এলাকা। শূন্য হাতে অচেনা জায়গায় জীবনের মৌলিক সমস্যায় পড়ে অসহায় মানুষগুলো চারিদিকে অন্ধকার দেখতে থাকে। একইসঙ্গে কলকাতায় বসবাসকারী মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনেও নেমে আসে অপ্রত্যাশিত দুর্দশা। বাঁচার তাগিদে বিপুল সংখ্যক মানুষের জীবনে ঘটে অবনমন। গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র ঠিক এই সময়ে বাংলা ছোটগল্প রচনায় হাত দেন। রবীন্দ্রনাথ আর তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের (মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর) সৃষ্টিসম্ভারে বাঙলা সাহিত্যের আকাশ তখন আলোকময়। সেই আলোকদীপ্র সময়ে নরেন্দ্রনাথ গল্পের জগতে নিজেকে প্রকাশ করেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্র ব্যক্তিমানুষ হিসেবে ছিলেন মানবিক ও সংবেদনশীল। ফলে প্রত্যক্ষ বিশ্বরাজনীতি ও ভারতবর্ষের অভ্যন্তরীণ সংকট ও তা থেকে সৃষ্ট ক্ষত তাঁর শিল্পীহৃদয়ে গভীর ছাপ ফেলে। চল্লিশদশকের বিক্ষুব্ধ সময় ও তার করুণ পরিণতি তাঁর লেখায় জায়গা পেতে থাকে সামাজিক দায়বোধ থেকে। লেখনি শুরু করেছিলেন ১৯৩৬-সনে দেশ পত্রিকায় ‘মূক’ নামক কবিতা দিয়ে। একই বছরে ঐ পত্রিকাতে প্রথম গল্প ‘মৃত্যু ও জীবন’ লিখে পা রাখেন গল্পের আঙিনায়। তারপর থেকেই নিয়মিত লিখে চলেন গল্প, প্রবন্ধ ও উপন্যাস। তবে সাহিত্যের অন্য শাখা থেকে ছোটগল্প বিনির্মাণে সবচেয়ে বেশি সফলতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। বলতে দ্বিধা নেই তাঁর গল্প বৈশিষ্ট্যে ও অভিনবত্বে বাংলা সাহিত্যে তথা বিশ্বসাহিত্যে এক অনন্য সৃষ্টি। 

নরেন্দ্রনাথের গল্প, উপন্যাস মূল্যায়নে একশ্রেণির সাহিত্যিক ও গবেষক বলেছেন তিনি নাগরিক মনস্ক মধ্যবিত্ত জীবনের পালাকার। আবার আরেক শ্রেণীর সাহিত্য সমালোচক তাঁকে অভিহিত করেছেন মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের চিত্রকর হিসেবে। কেউ কেউ আবার তাঁর গল্পে সমসাময়িক ঘটনার প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই বলেও অভিমত রেখেছেন। অর্থাৎ রাজনীতির প্রত্যক্ষ উত্তাপ নিয়ে কম গল্প রচনা করেছেন নরেন্দ্রনাথ। কিন্তু সত্যি কথা হলো তাঁর গল্পে সে সময়ের ঘটনা নয় বরং ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় জনজীবনের যে অবর্ণনীয় কষ্ট ও যাতনা তা নিখুঁত ভাবে শিল্পিত সত্যের অঙ্গীকারে পরিস্ফুটিত করেছেন। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের গল্পের শরীর জুড়ে আছে দেশভাগোত্তর সময়ের বিপন্ন ও অসহায় মানুষের মর্মন্তুদ চাহনি। তাঁর গল্পের বিষয় সম্পর্কে বলতে গিয়ে সমালোচক বলেন,‘দেশের দুর্দশা মন্বন্তর এবং মানুষের মধ্যে যে বেকারত্ব,হতাশা বোধ এসেছিল সেই সব নিয়েই তিনি গল্প উপন্যাস রচনা করেছেন। তাই তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যে যুদ্ধ বা মন্বন্তরের তুলনায় যুদ্ধ বা মন্বন্তরের কবলে পড়া মানুষের দুর্দশার কথা বেশি পাওয়া যায়।’ (সঞ্চয় প্রামাণিক)। ১৯৪৭-এর বেদনাময় ঘটনা ঘরহারা মানুষের কপালকে ঢেকে দেয় অন্ধকারে। উন্মূল এই মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত অসহায় বাঙালি আশ্রয় নেয় ফুটপাত, রেলষ্টেশন ও বস্তিতে। পূর্ব-জীবনের প্রবহমান অর্থনৈতিক বিন্যাস নষ্ট হবার কারণে তারা প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়ে। নতুন জায়গায় ছিন্নমূল মানুষ দেখতে পায় শুধু নিরাশা, দুঃখ আর ব্যথা-বেদনা। এই বিপন্ন বাঙালির জীবন প্রতিবেশ, তাদের বিক্ষিপ্ত সামাজিক বিন্যাস, বেঁচে থাকার ব্যাকুল চেষ্টা, ঘটনার চাপে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা এবং নর-নারীর সম্পর্কের নানান দিককে গল্পে সযত্নে তুলে ধরেছেন নরেন্দ্রনাথ মিত্র। বিক্ষিপ্ত সময়ের ছিন্নমূল মানুষের ভেতরের এই বেদনাকে শিল্পরূপ দিতে গিয়ে তিনি রাজনীতি ও দাঙ্গার মত ভয়ানক ক্ষতকে নিয়ে আক্ষরিক অর্থে খুব বেশি গল্প রচনা করেননি।

নিজের গল্প সম্পর্কে তাই এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘ঘৃণা বিদ্বেষ ব্যঙ্গ বিদ্র্র্রুপ বৈরিতা আমাকে লেখায় প্রবৃত্ত করেনি। বরং বিপরীত দিকের প্রীতি প্রেম সৌহার্দ্য, শ্রদ্ধা,ভালোবাসা,পারিবারিক গন্ডির ভেতরে ও বাইরে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিচিত্র সম্পর্ক বার বার আমার গল্পের বিষয় হয়ে উঠেছে।’ আমরা তাঁর গল্পে মধ্যে তাই চেনা মানুষের সমস্যা,তা থেকে উত্তীর্ণ হবার সংগ্রাম এবং  তাদের সদর্থক পরিণতির প্রচেষ্টাকে লক্ষ করি। ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তিমানুষের মর্মবেদনার সুরটিকে তিনি অনুরণিত করে’ তুলেছেন গল্পসমূহের ভেতর। নরেন্দ্রনাথের গল্পকে নিবিড় ভাবে পড়লে গল্পগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে দেখা যেতে পারে। ক. দেশভাগের গল্প খ. প্রেমের গল্প গ. অর্থ-সংকটের গল্প ঘ. সামাজিক সমস্যার গল্প ঙ. মনস্তত্তে¡র গল্প চ.পতিতাদের গল্প এবং ছ.বিধবাদের নিয়ে গল্প। বিষয়বৈচিত্র্য প্রবণতার প্রেক্ষাপটে বিভাজনকৃত গল্পগুলো যেমন জীবনবাস্তবতার বিচারে উজ্জ্বল, তেমনি স্বতন্ত্র পরিচয়েও দীপ্যমান। দেশভাগ পরের ইতিহাসে চোখ রাখলে আমরা লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষের পরিবর্তনশীল জীবনকে পাই। যারা প্রতি মুহূর্তে পিষ্টিত হয়েছে নিজেদের সমস্যায়। মাথা গোঁজার সুযোগ পেয়ে মানুষগুলো শৈশবে অর্জিত মূল্যবোধ বিসর্জন দিতে থাকে বাঁচার আশায়। গল্পকারের দেশভাগের উপর রচিত গল্পের মধ্যে আমরা এই অসহায়ত্বের প্রত্যক্ষ পরিচয় পাই। এ জাতীয় গল্প হচ্ছে, ‘দাতা’, ‘হেডমাস্টার’, ‘পেশা’, ‘আকিঞ্চন’, ‘কাঠগোলাপ’, ‘চিঠি’, ‘ঠোঙা’, ‘চিহৃ’, ‘রঙ’, ‘শুল্ক’ প্রভৃতি। জীবনের মৌল অনুভূতির নাম প্রেম। সব শিল্পের প্রেরণা হিসেবে কাজ করে এই প্রেম। নরেন্দ্রনাথ মিত্রের প্রেম নির্ভর গল্পের সংখ্যা প্রচুর। তাঁর রচিত প্রেমের গল্পের রকমফেরও অনেক। তার মধ্যে অসম প্রেমের গল্প,দাম্পত্য প্রেমের গল্প,অবৈধ প্রণয়ের গল্প,অবিবাহিত নর-নারীর গল্প প্রভৃতি। মানবজীবনের সঙ্গে টাকার সম্পর্ক অভিন্ন। মধ্যবিত্ত ও  নিন্ম্নবিত্ত মানুষের এই অর্থ-সংকটের কথা নরেন্দ্রনাথের গল্পে নিখুঁত ভাবে ফুটে উঠেছে। সাহিত্যের ভিন্ন সংরূপ থেকে কথাসাহিত্যে জীবন ও টাকার সংযোগ প্রবল। বাংলা উপন্যাসে যাঁদেও লেখায় প্রথম অর্র্থ-সংকটের কথা পাই,তাঁরা হলেন-তারকনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের। এরপর অর্থ-সংকটকে দেখতে পাই রবীন্দ্রনাথের ‘দেনাপাওনা’ গল্পে। কিন্তু ততদিনে ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর অর্থনৈতিক পরিকাঠামো যে মানব অস্তিত্বের নিয়ামক-এই নির্মম সত্যের মুখোমুখি হয় কথাসাহিত্য।’ অতঃপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে বিশ্ব বাজারে যে অর্থনৈতিক মন্দা নেমে আসে তার প্রভাব পড়ে বাঙালি জীবনে। যুদ্ধ, মন্বন্তর, দাঙ্গা আর দেশভাগের ফলে দেশে বেকারের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বিরূপ এই পরিস্থিতিতে অর্থের কারণে জীবনের সকল ক্ষেত্র ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। একজন বড় মাপের শিল্পী হিসেবে নরেন্দ্রনাথ মিত্র বিষয়টিকে গভীর ভাবে অনুভব করেন। 

এবং অসামান্য দক্ষতায় তাঁর গল্পে টাকা ও মনস্তত্তে¡র আশ্চর্য রসায়ন ঘটান। বিত্তহীন মানুষের অর্থ-সংকটের উপর তিনি লিখেছেন,‘চোর’,‘সিগারেট’, ‘একটি দশ টাকার নোট’,‘চড়াই-উৎরাই’ ও ‘ছবির’ মত অসাধারণ গল্প। গল্পের ভাষা নির্মাণের ক্ষেত্রেও নরেন্দ্রনাথ মিত্র বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। গল্পের প্লটের সঙ্গে চরিত্রের কার্যকারণ সূত্র গড়ে ওঠে ভাষার মাধ্যমে। কেননা কাহিনি চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় গল্পের চরিত্রসমূহের পারস্পরিক সংলাপের ভেতর দিয়ে। ফলে ভাব-বস্তুর সঙ্গে যথাযথ ভাষা ব্যবহারের মাধ্যমে একজন সাহিত্যিক তাঁর সাহিত্যকর্মকে শিল্পিত মাত্রায় নিয়ে যেতে পারেন। শুধু তাই নয় একজন কৃতিমান লেখকের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো গল্পের ভাষায় স্বাতন্ত্রিকতা তৈরি করা। নরেন্দ্রনাথ মিত্র তাঁর গল্পে ভাষার বৈচিত্র্য ব্যবহারেও কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ভাষা প্রয়োগে সমকালের অন্য গল্পকারদের থেকে যে স্বতন্ত্রের পরিচয় দিয়েছেন তা’হলো তাঁর গল্পে ভাষার প্রাঞ্জল ব্যবহার। গল্পের ভাষা সহজ-সরল বলে তা পাঠ করে পাঠকের ক্লান্তি অনুভব হয়না কখনো। গল্পকারের বিখ্যাত ‘পালঙ্ক’ গল্পের একটি ছোট্ট উক্তির মাধ্যমে ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁর যথার্থ দক্ষতার পরিচয় অনুভব করা যায়,‘দুধে জল মিশাইছস বইলা চিঠিতেও জল মিশাইছস? তোর সবটাতেই জল হারামজাদা? নরেন্দ্রনাথ মিত্র একজন ছোট গল্পের বড় লেখক। কিন্তু শক্তিশালী কথানির্মাতা হয়েও তিনি অনেকটাই যেন পাঠকের আড়ালে রয়েছেন। অথচ তাঁর রচনায় দেখানো সমাজ ও মানুষকে আমাদের অগ্রগতির প্রয়োজনেই আজ একান্তভাবে জানা দরকার। বিখ্যাত এ-লেখকের সৃষ্টির পরিচয় জানতে এবং চল্লিশ থেকে সত্তর দশকের বিপন্ন মানুষের জীবনবাস্তবতা বুঝতে পাঠকের তথা আমাদের তাই ওঠে আসতে হবে তাঁর সৃষ্টির আঙিনায়। কিন্তু সে জন্য আমাদের থাকতে হবে গভীর অনুসন্ধিৎসু মন। ভেতরে রাখতে হবে অসীম ধৈর্য ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র বাঙালি পাঠককে ছেড়ে চলে গেছেন আজ থেকে ৫০ বছর আগে। কিন্তু রয়েছেন মানব হয়ে তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টির মধ্যে। কৃতিমান এই লেখককে স্মরণে এনে শ্রদ্ধাভরে রবীন্দ্রনাথের ভাষায়  বলতে চাই-

জীবনের যাত্রাপথে যাত্রীদল চলে

বিরাম বিরতিহীন কে বা মনে রাখে।

তবুও তারি মাঝে ক্ষণিক দাঁড়ায়ে স্মৃতির ফলকে

যাঁরা পদচিহ্ন রাখে,তারা মনে থাকে।

গত ১৩সেপ্টেম্বর-২০২৪ ছিল (২৯ ভাদ্র-১৪২৭) প্রতিভাবান এ-গল্পকারের ৫০তম মৃত্যুবার্ষিক। মহাপ্রয়াণের দিনটি স্মরণে লেখকের প্রতি অকৃত্রিম ও বিনম্র ভালোবাসা। নরেন্দ্রনাথ মিত্র বাঙালি পাঠকের মাঝে বেঁচে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আজ, এখন, তখন এবং সর্বক্ষণ।