প্রাক- ইসলামী আরবে নারী স্বাধীনতা এবং একজন হিন্দা

Jun 20, 2024 - 20:38
Jun 26, 2024 - 19:50
 2  242

ইসলাম ধর্ম ও আরবদের ইতিহাসের সূচনাতেই পাঠকদের জানান হয়, প্রাক ইসলামী বা আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগের আরবে নারীদের অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। মেয়ে শিশুদের জন্ম হলে আরবগণ প্রমাদ গুণতেন। তারা নারী সন্তানদের জীবন্ত করব দিয়ে হত্যা করে কলঙ্কমুক্ত হতেন।

কিন্তু আরবদের ইতিহাসের পাঠ যতটুকু আমি নিয়েছি তাতে এখন পর্যন্ত কোন প্রমাণ পাইনি যে প্রাক-ইসলামীযুগের কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি তার নির্দিষ্ট কোন কন্যা সন্তানকে জীবন্ত করব দিয়ে কলঙ্ক থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছিলেন। বরং  ইতিহাসের পাতায় প্রাক-ইসলাম ও ইসলামের প্রাথমিক যুগেও নারীদের উল্লেখযোগ্য, এমনকি, প্রতিবাদী ভূমিকার পরিচয়ও পাওয়া যাবে।

ইসলামের ইতিহাসের পাঠকদের কাছে কয়েকজন পরিচিত নারীর মধ্যে হিন্দা বিনতে উতবা অন্যতম। এ নারী ছিলেন কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ানের স্ত্রী। কেবল আবু সুফিয়ানের স্ত্রী বলেই নয়, বরং নিজ গুণেই হিন্দা  ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই ইতিহাসে একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন। পাঠকরা হিন্দার সাথে পরিচিত হবেন  বদরের যুদ্ধের সময় থেকেই।  তবে ওহুদের যুদ্ধের সময় তিনি ইতিহাসের সম্মুখভাগে উঠে আসেন।

 হযরত হামযা (রা) বদর যুদ্ধে হিন্দার বাবা ও ভাইকে হত্যা করেছিলেন। তাই হিন্দা শপথ নিয়েছিলেন, তিনি সুযোগ পেলে প্রতিশোধস্বরূপ হযরত হামযার কলিজা চিবিয়ে খাবেন। বদর যুদ্ধের পর ওহুদের যুদ্ধ সংঘটিত হলে কুরাইশ বাহিনীর হাতে মুসলিম বাহিনীর আপাত পরাজয় ঘটে। যুদ্ধে ওয়াহশী ইবনে হারব নামের এক আবিসিনিয়ান কৃতদাসের বর্ষার আঘাতে হযরত হামযা শহিদ হলে হিনদা হামজার নাক, কান ও অন্যান্য অঙ্গ কর্তন করে এবং কর্তিত কলিজা মুখে পুরে চিবিয়ে তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করেন।  

ওহুদের যুদ্ধের পর কেটে গেছে অনেক বছর। এর মাঝে মক্কার কুরাইশগণ মুসলমানদের বিরুদ্ধে খন্দকের যুদ্ধসহ একাধিক যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ইসলামের বিস্তার ও বিজয় ঠেকাতে পারেননি। অবশেষে মহানবী বিনাযুদ্ধে বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করেন।  মক্কা অবরোধকালে কুরাইশগণ যখন দেখল মুহাম্মদের(স) বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের জয়লাভ করা সম্ভব নয়, তখন তারা মুসলমানদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে প্রবৃত্ত হল।

 মুসলিমদের সাথে আলোচনার এক পর্যায়ে কুরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান মহানবীর চাচা আব্বাসের (রা) সহায়তায় মুহাম্মদ(স) এর তাবুতে পৌঁছে আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করে মক্কাবাসীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চাইলেন। মহানবী(স) নিরস্ত্র মক্কাবাসীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলে আবু সুফিয়ান ফিরে গিয়ে মক্কাবাসীদের উদ্দেশ্যে এক ভাষণে আহব্বান জানালেন যে, তারা যেন যুদ্ধ থেকে বিরত থেকে নিজেদের ঘরে অবস্থান করেন। অন্যথায়, মুহাম্মাদরে বিশাল বাহিনীর হাতে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। 

 কিন্তু আবু সুফিয়ানের এ আত্মসমর্পণের আহব্বান অনেক মক্কাবাসীর মতো তার স্ত্রী হিন্দাও মেনে নিতে পারেননি। এই বীর নারী উপস্থিত জনসম্মুখে আবু সুফিয়ানের দাড়ি ধরে টান দিয়ে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন,

 "হে মক্কাবাসী আপনারা এই ভুড়িয়ালা বৃদ্ধ কাপুরুষটির কথা মান্য করবেন না। আপনারা বীরের মতো মুহাম্মাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন"।

 যদিও হিন্দার আহব্বান উপেক্ষা করে মক্কাবাসী অসম যুদ্ধে জীবন দেয়ার পরিবর্তে ঘরে বসে থাকাই উত্তম মনে করেছিল, তথাপিও কুরাইশ নেতার বিপরীতে হিন্দার অবস্থান গ্রহণ প্রাক-ইসলামী যুগে নারীদের শক্তিশালী অবস্থানই নির্দেশ করে।

মক্কা বিজরের পর কুরাইশদের প্রায় সকল নারী পুরুষই ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত হন। এ ক্ষেত্রে লক্ষণীয় হল যে আবু সুফিয়ান ইসলাম গ্রহণ করার অনেক পরে তার স্ত্রী হিন্দা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তার অর্থ হল, আরবের নারীগণ সেই সময় তাদের স্বামীদের কাছ থেকে ধর্মীয় স্বাধীনতাও ভোগ করতেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের সময় মহানবীর সাথে হিন্দার কথোপকথন থেকেও তার স্বাধীন ইচ্ছা ও যুক্তিবাদী মনের প্রমাণ পাওয়া যায়। বায়আতের উদ্দেশ্যে মহিলারা রাসূলুল্লাহ (সা) এর কাছে আসলে নবী বলেন, তোমরা আমার নিকট এই মর্মে বায়আত গ্রহণ কর যে, আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করবে না। এ সময় হিন্দা বলে ওঠেন, ‘আল্লাহ কসম। আপনি আমাদের থেকে এমন অংগীকার নিচ্ছেন, যা পুরুষদের কাছ থেকে নেননি। অর্থাৎ বায়আতের সময় নারী পুরুষের মধ্যে পার্থক্যটুকুও তার নজরে এড়ায়নি এবং তিনি সাথে সাথেই এ কথিত বৈষম্যের  প্রতিবাদ করেছেন।

বায়আতের এক পর্যায়ে মহানবী (স) নারীদের  উপদেশ দিলেন, 'তোমরা তোমাদের সন্তানদের হত্যা করবে না’।  এসময় হিন্দা আবার প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। তিনি মহানবীর মুখের উপরই বলে দিলেন, ‘আমরা আমাদের সন্তানদের শিশুকালে লালন-পালন করেছি। কিন্তু তারা বড় হবার পর আপনি ও আপনার সাহাবীরা তাদেরকে বদর প্রান্তরে হত্যা করেছেন'।

ইসলামের ইতিহাসে আরো অনেক নারীই রয়েছেন যাদের ভূমিকা প্রমাণ করে যে কথিত আইয়ামে জাহেলিয়াত যুগে নারীদের নিম্নতর অবস্থান সম্পর্কে যা বলা হয়, প্রকৃত অবস্থা ছিল তার বিপরীত। তবে ইসলাম গ্রহণের পূর্বে ও পরের অবস্থা বিবেচনায় হিন্দাই প্রাক ইসলামী যুগের নারী স্বাধীনতার উত্তম সাক্ষ্য বহন করে।

সূত্র: আবুল ফিদা হাফিজ ইবন কাসীর আদ-দামেশকী(র) আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, অনুবাদ- ড. আহমদ আবূ মূলহীম ও অন্যরা, বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশন, ২০০৪, পঞ্চম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬০৫; ষষ্ট খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৭৮-৪৭৯ সপ্তম খণ্ড পৃষ্ঠা-৯৮)


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। বর্তমানে ৪ এপিবিএন, বগুড়ার অধিনায়ক