পান্তা-ভাত বাঙালির বিলাসিতা নয় ; স্বকীয় খাদ্য সংরক্ষণ প্রযুক্তি

Apr 18, 2025 - 00:05
Apr 22, 2025 - 16:58
 0  26
পান্তা-ভাত বাঙালির বিলাসিতা নয় ; স্বকীয় খাদ্য সংরক্ষণ প্রযুক্তি
সায়মা মালিহা, অষ্টম শ্রেণি
বাংলা নববর্ষ আসলেই আমাদের সমাজে পান্তা-ইলিশ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। কেউ বলেন, পান্তা-ভাত আমাদের বাঙালিত্বের বহিঃ প্রকাশ। বাঙালিদের আবহমান কালের প্রাত্যহিক প্রাতঃরাশ। আবার কেউ কেউ বলেন, বাঙালি পান্তা ভাত খায়, তা ঠিক আছে। কিন্তু পান্তাভাতের সাথে ইলিশ ভাজার সংযোজনটা আবহমান কালের নয়, শহুরে বাবুদের আনুষ্ঠানিক বিলাস। আর বাঙালি কেন? বাংলাদেশের বাঙালিরা তো মুসলমান। তাদের আবহমান প্রথাগুলো তো পরিত্যাজ্য। তাদের সংস্কৃতি হবে আরব থেকে আসা খাসা মুসলমানী। মুসলমান হলে বাঙালিত্ব বিসর্জন দিতে হবে, আর বাঙালি হলে মুসলমানিত্ব  হালকা হয়ে পড়বে।

আলোচনার এ পর্বে আমাদের জানা উচিৎ যে, বাঙালিত্ব একটি নৃতাত্ত্বিক পরিচয়। এটা রাজনৈতিক কিংবা ধর্মীয় কোন দিক থেকেই গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিচয় মানুষের আরোপিত কিংবা অর্জিত। আমি ইচ্ছা করলে মুহূর্তের মধ্যে আমার ধর্ম পরিবর্তন করতে পারি কিংবা ধর্মহীনও হতে পারি। আমার রাজনৈতিক পরিচায় যে কোন সময় পরিবর্তনযোগ্য। আমি চাইলে যে কোন সময় আমার নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে পারি কিংবা যে কোন রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের নাররিক হতে পারি।

কিন্তু আমি চাইলেই বাঙালিত্ব পরিত্যাগ করতে পারি না। অবাঙালি হওয়ার ভান করা যায়। কিন্তু বাঙালিরা রাতারাতি অবাঙালিতে পরিণত হতে পারে না। একজন মানুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় পরিবর্তন করা সম্ভব না হলেও তার পরবর্তী প্রজন্মগুলো ক্রমান্বয়ে অন্য কোন নৃতত্ত্বের মধ্যে ঢুকে যতে পারে। তবে পূর্ব পুরুষের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় থেকে বের হয়ে অন্য কোন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীতে বিলিন হতে  তার অন্তত কয়েক ডজন প্রজন্মের প্রয়োজন হবে।  বাঙালির  পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাভাষা ভুলে গেলেও তারা যদি একই পরিবারে বসবাস করে, তাদের পক্ষে বাঙালিত্ব ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। পরবর্তী প্রজন্মরা হয়তো কিছু কিছু অভ্যাস ও আচার অপছন্দ করবে, কিছু নূতন আচার সংযোজন করবে, কিন্তু সব মিলে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন অভ্যাস ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে শতাব্দীর পর শতাব্দীর প্রয়োজন হবে।

ব্যক্তিগতভাবে, পান্তা ভাত আমার কাছে একটি লোভনীয় খাবার। এটা আমার ও আমার পরিবারের কাছে কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়। তাই শখ করে আমি কেবল পহেলা বৈশাখেই পান্তা ভাত খাই না। আমি পান্তা খাওয়া শুরু করি মার্চের শুরু থেকেই এবং ছেদ দেই অক্টোবরের শেষ দিকে। এসময় নিয়মিত না হলেও অনিয়মিতভাবে আমি পান্তা ভাত খেয়ে থাকি।

নিতান্ত দায়ে পড়ে অতিরিক্ত ভাত ফেলে দেয়ার পরিবর্তে পানি দিয়ে সংরক্ষণের ফলে বাঙালি সমাজে প্রচলিত হয়েছিল পান্তাভাতের প্রচলন। কিন্তু বাঙালির কি জানত যে ভাতের সাথে পানি মিশিয়ে সাত আট ঘন্টা রেখে দিলেই তার ভিতর খাদ্যের উপাদানগুলো আরও সমৃদ্ধ হবে এবং নূতন নূতন উপাদানও যোগ হবে?  বিবিসির অনলাইন পোর্টালের খবরে বলা হচ্ছে, ভারতের আসাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি জৈব প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. মধুমিতা বড়ুয়ার নেতৃত্বে একটি গবেষণা দল পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণ নিয়ে রীতিমত গবেষণা করে দেখেছেন, কেবল পান্তা হওয়ার জন্যই ভাতের খাদ্যগুণ নানা কারনে বেড়ে যায়।

গবেষণায় দেখা যায় গরম বা টাটকা ভাতের মধ্যে ফাইটেটের মতো এন্টি-নিউট্রিশনাল ফ্যাক্টর  গুলো আয়রন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও জিংকের মতো পুষ্টিকর পদার্থকে বেঁধে রাখে। ফলে ভাত খাওয়ার পরেও মানুষের শরীর এসব গ্রহণ করতে পারে না। কিন্তু ফারমেন্টেশনের কারণে পান্তা ভাতের ফাইটেট দুর্বল হয়ে পড়ে এবং তখন পুষ্টিকর পদার্থগুলো উন্মুক্ত হয়ে পড়লে আমাদের শরীর সেগুলো গ্রহণ করতে পারে। অর্থাৎ ভাত কেবল পান্তা হওয়ার কারণেই আমাদের পাকস্থলীতে গিয়ে ইতোমধ্যে প্রাপ্ত খাদ্য উপাদানগুলোকে শরীরের গ্রহণ উপযোগী করে তোলে। সাধারণভাবে ১০০ মিলিগ্রাম ভাতে আয়রনের পরিমাণ থাকে ৩.৫ মিলিগ্রাম। কিন্তু ১২ ঘণ্টা ভিজিয়ে পান্তায় পরিণত হলে তা  ৭৩.৯ মিলিগ্রাম। একই পরিমাণ সাধারণ ভাতের ২১ মিলিগ্রাম ক্যালশিয়াম পান্তায় বেড়ে গিয়ে দাঁড়ায় ৮৫০ মিলিগ্রাম। একই ভাবে পান্তাভাতে ল্যাকটিক অ্যাসিড তৈরি হয় বলে সেটা দইয়ের মতো উপকারী হয়।

এটা ঠিক যে পান্তার সাথে ইলিশ ভাজি শিক্ষিত শহুরে-বাঙালিদের সংযোজন। আমরা ছোটকালে পান্তার সাথে ইলিশ ভাজি খেতাম না। কারণ, তখন আমাদের বিত্ত-বৈভব ছিল না। তাই আমাদের মুরব্বিরা পান্তার সাথে মরিচ ডলে পিঁয়াজসহ দ্রুত খেয়ে মাঠের দিকে ছুটতেন। আর আমরা, ছোটরা, পান্তা খেয়ে হয় পাঠশালায় নয়তো ডাঙুলি খেলতে ছুটতাম।  তাই পান্তা-মরিচ হল কৃষকদের প্রাতঃরাস। আর পান্তা ইলিশ হল বাবুদের কারুকাজ। গ্রামের কৃষকের কাছে যা নিত্য প্রয়োজন, শহুরে বাবুদের কাছে তা আনুষ্ঠানিক বিনোদন।

বাংলাদেশের সমাজ এখনও প্রকৃত অর্থে শহুরে জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারেনি। শহরে বসবাস করার মানুষগুলোর প্রায় সকলেরই নাড়ি পোতা আছে কোন না কোন গ্রামে। যারা একেবারে শহরেই জন্মগ্রহণ করেছে, তাদের স্বজনদের আবাস গ্রামে। তাদের শহুরে প্রতিবেশিদের অবস্থাও তাই। ফলে শহুরে কমিউনিটির সামষ্টিক সংশক্তি গ্রামের চেয়ে নিতান্তই নগণ্য। ফলে গ্রামের সাথে নাড়ির টানযুক্ত মানুষগুলো শহরে থিতু হলেও এখনও পান্তা ছাড়তে পারেনি।

তবে তাদের পরবর্তী প্রজন্মদের অনেকেই পান্তার উপযোগিতা অনুভব করতে পারে না। কারণ আধুনিক জীবনে রিফ্রেজারেটর ও তার বিপরীত মাইক্রোওভেন ভাতকে পান্তা হওয়ার সুযোগই দেয় না। অথচ, খাবারের পর অবশিষ্ট ভাতটুকু সংরক্ষণের জন্য আবহমান বাংলার মানুষ যে নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাই পান্তা ভাত। আধুনিক প্রযুক্তি পান্তা-প্রযুক্তিকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুললেও আমাদের বাঙালি মনে পান্তা ভাত এখনও অনেকটুকু স্থান জুড়ে রয়েছে। হয়তো আরও কয়েকটি প্রজন্ম পর্যন্ত তা থাকবে।

তবে একথা মানতেই হবে যে, যারা নিরূপায় হয়ে পান্তা খেয়ে লাঙল কাঁধে  মাঠের দিকে ছোটেন তারাও আমার পান্তা-সাথী, যারা পহেলা বৈশাখে রমনা পার্কে গরম ভাতে পানি দিয়ে ভাজা ইলিশে সাঁতার উপভোগ করেন, তারাও আমার বাঙালি সুহৃদ। সব কিছু ভুলতে পারি, কিন্তু বাংলা ও বাঙালিদের নয়। মানুষ হিসেবে সব সত্বই পরিত্যাগ করা যায় কিন্তু নৃতত্ত্ব পরিত্যাগ করা যায় না।

রচনা সূত্র।

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ৪ এপিবিএন স্কুল ও কলেজ অনলাইন জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা-পৃষ্ঠপোষক, ৪ এপিবিএন, বগুড়ার সাবকে অধিনায়ক। বর্তমানে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, মিরপুর, ঢাকা এর মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ।