পরিবর্তীত সময় ও কবিতা ক্ষেত্র
পরবর্তী সংখ্যা
আধুনিক মানুষ বৈচিত্র্য-সন্ধানী ও বিচিত্রগামী। মানুষের হাতে সৃষ্ট কবিতা তাই নানারূপ অভিসারী বুনন চর্চায় অভিষিক্ত। চেতনাস্নাত মানব স্বাভাবিক চোখে দেখে, পৃথিবীর সভ্যতা-সংস্কৃতি, সমাজ ও ইতিহাস প্রত্যেক কবির তৃষিত মনে সাবলীল মিলন অপরিহার্যতা কামনা করে। অসাধারণ প্রতিটি সফল কবিতা তাই স্বতঃপ্রণোদিত এবং দর্শনের চেতনাযুক্ত শিল্প। এই দর্শন চেতনা কল্পরূপ নির্ণয় জ্ঞাপক এবং বিজ্ঞান চেতনা যুক্ত। ফলে এই দর্শন বিজ্ঞানচেতনার প্রথম ধাপ। কবিতা নির্মাণের বেলায় দর্শন তাই চেতনার অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে ওঠে।
শব্দ-ই কবিতার শরীর। এই শব্দের খেলার মধ্যে কবিরা জটিল পৃথিবীর সীমাহীন সমস্যাকে গভীর দ্যোতনায় শিল্পরূপ দেন। সীমাবদ্ধ বৃত্তে কবিতার ভাবকে প্লাবিত করা দুরূহ হয়ে ওঠে। ফলে প্রতিভাধর কবিরা সীমাবদ্ধতার মার্জিন ভেঙ্গে কবিতার মধ্যে নানা মতবাদকে অন্তর্ভুক্ত করেন। এবং একইসঙ্গে তাতে প্রয়োগ করেন ভিন্ন ভিন্ন প্রকরণ ও কৌশল। কবিতা প্রেকিক মাত্রই জানেন শব্দ ও অর্থ মিলেই হয় কবিতা। আর এ কারণে শরীরে প্রতিমার সঙ্গে কবিতার আত্মায় অর্থের ব্যঞ্জনা ঘটলে তা প্রবল আবেদনে সপ্রতিভ হয়ে ওঠে। কবিতার সৌন্দর্য সৃষ্টিতে তাই ভূষণের প্রয়োজন যুগে যুগে অনস্বীকার্য হয়ে আসছে।
পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলে উৎকৃষ্ট কবিতার সন্ধানে কবিরা কবিতার মধ্যে ব্যবহৃত-‘হিয়া, হেরি, মম, যবে, তবে’ শব্দকে বর্জনের জোরালো ইঙ্গিত দেন। শব্দ প্রয়োগে তাই মিতব্যায়িতা লক্ষণীয় ব্যাপার হয়ে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ কবিতায় লেখেন- ‘ঘুরে ফিরে মনে হয়, বেশি কথা বলা হলো।’
প্রকরণ-শৈলীর পথ ধরে কবিতায় সাংকেতিক শব্দ প্রয়োগ শুরু হয় দুর্বার গতিতে। একটি কবিতার উৎকর্ষ নির্ণয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইঙ্গিতবহ সাংকেতিক শব্দ বড় ভূমিকা পালন করে। অবশ্য এতে লক্ষণীয় বিষয় হলো কবিতার ভেতর ব্যবহৃত শব্দ পাঠকের কাছে যেন জটিল বা দুবোধ্য না হয়ে ওঠে। আধুনিক কবিতায় প্রতীকের ব্যবহার বহুল প্রচলিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুটি বস্তুর মধ্যে তুলনা করতে প্রতীকের আশ্রয় নেন কবিরা। পাশ্চাত্যে এই প্রতীকী আন্দোলন গড়ে ওঠে, ফ্রান্সে উনিশ শতকের মধ্যভাগে। শার্ল বোদলেয়ারের লেখার মধ্য দিয়ে এর যাত্রা শুরু।
কবিতার ভাবধারা ও নির্মাণশৈলীর সঙ্গে চিত্রকল্পের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়। আধুনিক কবিতায় চিত্রকল্প ব্যাপক জায়গা জুড়ে আছে। বিশ শতকে লাওয়েল ও এজরা পাউন্ডসহ বিখ্যাত কবিরা কবিতার মধ্যে চিত্রকল্পকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছেন। দৃশ্যমান চিত্রকল্প ব্যবহারে ওয়ার্ডসওয়ার্থ, ফ্রস্ট ও রবীন্দ্রনাথ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। নিজের শব্দমালা দিয়ে তাঁরা সরল ও দৃশ্যমান চিত্রকল্প এঁকেছেন। যেকোনো সার্থক চিত্রকল্প কবিতাকে মালার মত গেঁথে রাখে। কবিতাশৈলীর গুণগত মানে উচ্চায়ত মাত্রা পেতে সংবেদনশীল স্থানে চিত্রকল্প ব্যবহার হয়ে থাকে।
ত্রিশ দশকের বৈশ্বিক আবহ-স্নাত বাংলা কবিতা আধুনিকতার সকল লক্ষণ নিয়ে হাজির হয়। বিষন্ন পৃথিবীর বিক্ষিপ্ত হাওয়ার স্পর্শে এবেং যুগ-সংকট অবলম্বন করে এ শিল্প সৃষ্টিপ্রক্রিয়া বেগবান হতে থাকে। কবিতা বিধস্ত মানবতার ক্রন্দন ব্যথিত মনোভূমিতে বেদনার বেহাগ সৃষ্টি করে। টি, এস এলিয়ট লেখেন-
This is the way the world ends
Not with a bang but a whimper, (The Hollow Men)
এই পটভূমিতেই বহুদর্শী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবিশ্বাস্য মানসিক স্থিতিস্থাপকতা তাঁকে আধুনিক কবিতা নির্মাণের কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করে। বলতে দ্বিধা নেই, তিনি এক-‘জীবন্ত চালচিত্র যার সামনে, যার প্রযত্নে ধীরে ধীরে নির্মিত হয়েছে আধুনিক কবিতার প্রতিমা,তার কায়া।’ বিশ শতকের প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে নিদারুণ দুঃস্বপ্ন, অবসাদ এবং ব্যক্তির বহুমুখী টানাপোড়নে চূর্ণ হয়ে যায় পুরনো বিশ্বাস ও মূল্যবোধ। জীবনানন্দ দাশের দাসের ভাষায়- ‘ইতিহাস এরমধ্যে কামাচ্ছন্ন, এখনো কালের কিনারায়।’
রবীন্দ্র-চেতনার আলো ঠিকরে পড়ে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ অধ্যায়ের তারুণ্যের উপর। আবার একই সাথে তাঁর হাতে ধরা দেয় বিংশ শতাব্দীর অসম্ভবের সম্ভাবনাও। জীবনের প্রাত্যহিক জীর্ণতা তাকে বারবার বেদনার অমৃতপানে বাধ্য করে। কিন্তু কবি বিপদের চরমতম মুহূর্তেও তিনি স্বীয় প্রজ্ঞার আলোয় উত্তীর্ণ হয়েছেন ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে।’ যার প্রভাব কবিকাহিনী (১৮৭৮) কিশোর লগ্ন থেকে গীতাঞ্জলি পর্যন্ত বিস্তৃত। (ক্রমশ)