পরিবর্তীত সময় ও কবিতা ক্ষেত্র
পৃথিবী পরিবর্তনের সঙ্গে মানুষের মানসিক বিবর্তনের পথ বেয়ে আধুনিক কবিতার জন্ম। মনোভূমির দ্বন্দ্ব, প্রক্ষেপ-প্রবণতা ও তার সংখ্যাতীত বিন্যাস এবং প্রতিবিন্যাস নিয়ে মানুষের মধ্যে দুটি প্রান্তিক অনুভব সতত সচল থাকে। যাপিত জীবনে এ অনুভাবনার একটি ব্যক্তির সুখানুভূতি এবং অন্যটি মর্মন্তুদ মনের দুঃখভার। সংবেদনশীল হৃদয়ের এ বেদনা যুগ থেকে যুগান্তরে সৃজনশীল মানুষকে বিবাগী করেছে হরষিত কিংবা বিষন্নতার ঘোরে। অপূর্ববস্তুনির্মাণক্ষম কবিমন তাই নিজের ভেতরের বিকশিত বাসনার ব্যাকুলতা থেকে গেয়ে ওঠেছে- ‘অলৌকিক আনন্দের ভার, বিধাতা যাহারে দেন তার বক্ষে বেদনা অপার।’
রহস্যঘেরা অন্তর্লীন মনের এই মথিত যাতনা সবেগে সৃষ্টির প্রবাহে আলোকিত করছে শিল্প-সাহিত্যের আঙিনা। বিষাদ যখন জীবনকে অস্থির করে, ঠিক তখনই কবি প্রতিভার অসাধারণ উৎসারণ কর রেখায় হাঁক দিয়ে যায়- ‘শান্তি কোথায় মোর বিশ্বভূবন মাঝে, অশান্তি যে আঘাত করে তাইতো বীণা বাজে।’ আমরা জানি কবিতায় যেমন ব্যক্তি-জীবনের সুখ-দুঃখ থাকে, তেমনি তাতে স্থান পায় সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য। কালের প্রবাহে আদিকাল থেকে কবিতা নানা ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে সামনের দিকে এগিয়েছে দিনের পিঠে। খ্রীষ্টপূর্ব সময় থেকে ভারতবর্ষের মানুষ ধর্মবিশ্বাসী চেতনায় বৃত্তবন্দি। ফলে খুব প্রাচীনকালের কবিতার অঙ্গে সর্বাগ্রে স্থান পায় দেবতার গুণকীর্তন।
তারপর মধ্যযুগে সেই দেবনির্ভরতাকে সে সময়ের কবিরা কবিতার মধ্যে বাস্তবতার নির্যাস রাঙিয়ে তাতে আনন্দ তরঙ্গ ও আবেদনের কলতান সৃষ্টি করেন। কিন্তু তবুও কবিতার মধ্যে সত্যিকার মন্ময়তা ও তন্ময়তার পুলকিত স্পন্দন বার্তা থাকে নাগালের বাইরে। সঙ্গত কারণেই পাঠককে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে সার্থক কবিতার নোঙরের জন্য। ১৭৬০ সালের পর কবিতার নতুন মাত্রা পর্ব গণনা শুরু হয়। কাব্যজগতে আবির্ভাব ঘটে মাইকেল মধুসূধন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩)। মধ্যযুগীয় চেতনার অবসান ঘটিয়ে বাংলা কাব্যসাহিত্যে আধুনিকতা স্পষ্ট করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তাঁর রচিত ‘ত্রিলোত্তমা সম্ভব’ (১৮৫৯) কাব্য, বাংলা কবিতার নতুন পথ নির্দেশ করে।
ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বিহারীলাল চক্রবর্তী (১৮৩৫-১৮৯৮) গীতিকবিতার সূত্রপাত ঘটান। ঠিক তার পরেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর প্রতিভার স্পর্শে বাংলা সাহিত্যকে বিচিত্রমুখী করেন। সময়ের পিঠে বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বাংলা কাব্যজগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। কবিতার শরীরে লাগে বহির্মুখী শিল্প-প্রকরণের ঢেউ। কবিতা সমালোচকদের আলোচনা চারদিকে প্রশাখা চারিয়ে দিয়ে বিশেষ একটি দিক উন্মোচিত করে। সেটি হলো শিল্প-নির্মাণের সীমাবদ্ধতাকে উৎরিয়ে যাবার স্পর্ধা। ত্রিশ-দশকের কবিতা তাই পাশ্চাত্য কাব্যভাবনাকে অনুসঙ্গ করে নতুন অবয়বে গতিশীল হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয় কবিতা আকার-প্রকার ও শৈল্পিক বুননে যথার্থ দার্শনিক ভাবনায় শক্তিশালী কাঠামোয় প্রস্বরিত হতে থাকে। এ সময় থেকেই বিশ্বের প্রতিভাধর কবিরা নানামুখী দর্শন তথা মতবাদ দিয়ে কবিতার অঙ্গে বৈচিত্র্যময় মাত্রা প্রযুক্ত করে কাব্য নির্মাণের আকাশকে প্রসারিত করেন। ফলে হাল আমলে নতুন প্রকরণের বৈভবে দেশে দেশে অসংখ্য কবির সৃজনী প্রভায় পরিবর্তীত শৈল্পিক কৌশলে নির্মিত হচ্ছে কবিতা।ইউরোপ-আমেরিকার কবিদের হাতের কবিতা, নিত্য-নতুন কাব্যিক ব্যঞ্জনা গায়ে-গতরে মেখে অভিনব দৃষ্টিতে হাতছানি দিচ্ছে প্রতিমুহূর্তে।
কবিতা তাই পূর্বের ‘প্রতীকী রূপ’ ছেড়ে ‘চেতনার প্রতীকী রূপ’ শরীরে ধারণ করতে শুরু করেছে। শিল্প হিসেবে কবিতা অনুভবের ও ভাবনার। আর এই ভাবনার ভরকেন্দ্রে স্থির হয়ে আছে ‘শব্দ।’ এস. টি কোলরীজের চিরায়ত মন্তব্য-`The best words in the best order’ গোটা বিশ্বে সমাদৃত। বাংলা সাহিত্যের দিকপাল কাব্য-সমালোচকগণ এই অভিমতকে স্বীকারও করেছেন। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন একটা অপূর্ণ রহস্যের মৌতাত ছড়িয়ে আছে অপরিহার্য শব্দবেষ্টিত কবিতায়। ফলে ‘শব্দ’ পরীক্ষা করে কবিতার তাৎপর্য নির্ণয়ের বেগটা ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে দিনের পর দনি। কিছুদিন আগে ইংল্যান্ডের তরুণ কবি- স্টিভেন ওয়েলস বলেছেন-‘Poetry is what looks like poetry, what sounds like poetry.’ অভিমতের সারকথা হলো- ‘যা পাঠে ও শ্রুতিতে গদ্যের মতো নয়, বক্তব্য সরাসরি নয়, ইঙ্গিতে প্রকাশিত- তাই কবিতা।’ এ সূত্রের বিচারে কবিতা নিয়ে, যা কিছু বলি না কেন-কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণের তাগিদে আত্মগত চেতনার বহিঃপ্রকাশ ছাড়া অন্য কিছু নয়। এখানে শব্দ, ধ্বনি অথবা বাচ্য নয়, বাচ্যের অধিক ব্যঞ্জনাই কবিতার প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে ভেতরের রহস্য কবিতার অপরিহার্য উপাদান হয়ে দাঁড়ায়। ( ক্রমশ )