গ্রাম-বাংলার প্রবাদ প্রবচন
‘কাচায় না নোয়ালে বাশ-পাকলে করে ট্যাশ ট্যাশ’ অর্থাৎ শিশুকালে নীতিশিক্ষা না দিলে উত্তরকালে হাজার উপদেশ দিলেও তা বৃথা যায়। এ রকম শত শত প্রবাদ-প্রবচন বাংলা লোক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রবাদ হলো: (A short sentence based on long experience) দীর্ঘ অভিজ্ঞতার একটি সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তি। প্রবাদ প্রবচনের মাধ্যমে বাঙালীর হাজার বছরের জীবন, ধর্ম, সংস্কৃতি, আচার, বিশ্বাস ও রসবোধের পরিচয় পাওয়া যায়। নিচে আমাদের লোকসমাজে প্রচলিত এমনি কিছু প্রবাদ প্রবচন ব্যাখ্যাসহ তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। রংপুর অঞ্চলের প্রবাদ:(১)সেদিন আর নাইরে নাথু, খাবলা খাবলা খাবা ছাতু। ব্যাখ্যাঃ আগের মত জিনিস-পত্রের দাম এত সস্তা নেই যে চাইলেই পর্যাপ্ত পরিমানে খাবার আয়েশ করে খাওয়া যাবে। (২) খাচ্ছিল তাতি তাত বুনে- কাল হল তার এড়ে গরু কিনে। ব্যাখ্যাঃ যে যে পেশায় অভিজ্ঞ তাতেই সে ভালো করে। অভিজ্ঞতা না থাকলে ভিন্ন পেশায় গেলে বিপদ হয়। (৩) ছোট কালে সোনামুখ, বয়সের কালে আয়না। বুড়া কালে বান্দরীমুখ-কেউর দিকে কেউ চায় না। ব্যাখ্যাঃ বয়সের সাথে সাথে মেয়েদের রুপের যে পরিবর্তন হয়, সেটাই বলা হয়েছে।(৪) উচঁ কপালী চিঁড়ল দাঁতী-লম্বা মাথার কেশ। এমন নারী করলে বিয়ে- ঘুরবে নানান দেশ। ব্যাখ্যাঃএখানে নারীর বাহ্যিক রুপকে প্রাধান্য দিয়ে বিয়ে করার পরিণাম বুঝানো হয়েছে। গুণ থাকলে , বাহ্যিক রুপ কোন ব্যাপার না। (৫) দ্যাশ বুইঝ্যা ব্যাশ, পাথার বুইঝ্যা চাষ । ব্যাখ্যাঃ দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী পোশাক পরিচ্ছদ পরতে হয়, আর জমির অবস্থা বুঝে চাষাবাদ করতে হয়। (৬) মুই করোম মাই মাই, মাইয়ের চোখোত পানি নাই। ব্যাখ্যাঃ যার জন্য করছি তার কোন ভাবান্তর নাই। (৭) ঘাঁটাত পানু কামার, দাও বানে দ্যাও হামার। ব্যাখ্যাঃ কাজের লোক নজরে পড়লেই কাজের কথা মনে পড়ে। বগুড়া অঞ্চলের প্রবাদ:(৮) অকাম করে বেহুদ্দা, ঝামেলা পোয়ায় গুষ্টি সুদ্ধা। ব্যাখ্যাঃ একজনের দোষে সবাই দোষী বুঝাতে বলা হয়। সিলেট অঞ্চলের প্রবাদ:(৯) ভালা মাইনসে মাইর খায়- গাল আতাইয়া বাড়িত যায়। ব্যাখ্যাঃ ভদ্রলোক ছোটলোকের কাছে অপমানিত হলেও জবাব দিতে পারে না। মান সম্মান নষ্ট হওয়ার ভয়ে চুপচাপ থাকে। (১০) এড়া মাউগ আগে হাজে, ফাটা ঢোল আগে বাজে। ব্যাখ্যাঃ-যে কম জানে সে সব কিছু আগে আগে করতে যায়। (১১) সারাদিন দিন অনে আর হনে/ হাই আইলে বারা বানে। ব্যাখ্যাঃ সারাদিন ঘোরাঘোরি করে, কিন্তু স্বামী ঘরে আসলেই কাজে লেগে যায় এমন নারীর ক্ষেত্রে বলা হয়। (১২) ধীরে আটে বয়না, তার লাগ কেউ পায় না। ব্যাখ্যাঃ অধ্যাবসায় ও স্থিতধী ব্যাক্তির জয় নিশ্চিত। ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রবাদ:(১৩) জামাই কৈন্যার দেখা নাই- শুক্কুর বারে বিয়া। ব্যাখ্যাঃ কেউ অতি আগাম পরিকল্পনা করলে এই প্রবাদ বলা হয়। চট্টগ্রাম অঞ্চলের প্রবাদ:(১৪) বেআক্কলরে আক্কল দিলে নিজের আক্কল ক্ষয়, আক্কলরে আক্কল দিলে আরো আক্কল হয়। ব্যাখ্যাঃ বুদ্ধিহীনরা সুপরামর্শ দিলে কোন কাজে লাগেনা, বুদ্ধিমানকে সুপরামর্শ দিতে গেলে আলোচনার মাধ্যমে নিজেরও কিছু বুদ্ধি বৃদ্ধি হয়। যশোর অঞ্চলের প্রবাদ:(১৫) কারো শাকে বালি-কারো দুধে চিনি। ব্যাখ্যাঃ ক্ষতিগ্রস্তের আরো ক্ষতি, লাভবানের আরো লাভ। চাঁদপুর অঞ্চলের প্রবাদ:(১৬) হস মাডিতে বিলাই খামসায়/ টাইড মাডিতে শাবলও ডরায়। ব্যাখ্যা: দুর্বলকে সবাই আঘাত করে, শক্তিমানরে ভয় করে। সাতক্ষীরা অঞ্চলের প্রবাদ:(১৭) হাড়ির খবর রাখে না ডাল ডাল করে । ব্যাখ্যা: আসল খবর না জেনে উল্টা পাল্টা কথা বলা। কুমিল্লা অঞ্চলের প্রবাদ: (১৮) আমার নাও আমার ছইয়া-আমিই থাকি বাইরে বইয়া। ব্যাখ্যাঃ মালিককে বাদ দিয়ে সুবিধা ভোগ করা। আরো কিছু সাধারণ প্রবাদ:(১৯) অগ্নি, ব্যাধি ও ঋণ, রেখোনা তিনের চিন (চিহ্ন)। ব্যাখ্যা: আগুন, ব্যাধি ও ঋণের শেষ রাখতে নেই; থাকলে এগুলি ক্রমশঃ বাড়তে থাকে। (২০) অতি চালাকের গলায় দড়ি, অতি বোকার পায়ে বেড়ি। ব্যাখ্যা: বেশি চালাক ও বেশি বোকা- উভয়ই বিপদে বেশি পড়ে। (২১) অরাঁধুনির হাতে পড়ে রুই মাছ কাঁদে; না জানি রাঁধুনি আমার কেমন করে রাঁধে। ব্যাখ্যা: উত্তমবস্তু পেতে গেলে উপযুক্ত লোককে দায়িত্ব দিতে হবে। অযোগ্য লোকের হাতে কাজ দিলে ভয়ে থাকতে হয়। (২২) আক্কেলে সকল বন্দী, জালে বন্দী মাছ; স্ত্রীর কাছে পুরুষ বন্দী ছালে বন্দী গাছ। ব্যাখ্যা: কেউ স্বাধীন নয়; জন্মের পরমুহূর্ত থেকে সবাই কোথাও-না-কোথাও বন্দী অবস্থায় থাকে। (২৩) আগে না বুঝিলে বাছা যৌবনের ভরে, পশ্চাতে কাঁদিতে হবে নয়নের ঝোরে। ব্যাখ্যা: যৌবনের অহঙ্কারে বেহিসাবী হ'লে বৃদ্ধবয়সে পস্তাতে হতে পারে। (২৪) আওয়াজওয়ালা বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারে না। ব্যাখ্যা: যে অযথা (বেশি) চিৎকার করে সে কোন কাজে সফল হতে পারে না। (২৫) উপকারী গাছের ছাল থাকে না। ব্যাখ্যা: কোন কিছুর বাহ্যিক রূপ দেখে তার গুণ বিচার করা হলে ভুল হতে পারে। (২৬) ঘোড়া চিনি কানে, রাজা চিনি দানে; নারী চিনি হাসে, পুরুষ চিনি কাশে। ব্যাখ্যা: কান দেখে যুদ্ধের ঘোড়া চেনা যায়; দানের পরিমাণ দেখে রাজার উদারতা জানা যায়; হাসি শুনে নারীর প্রকৃতি জানা যায় এবং বাচন ভঙ্গীতে পুরুষ চেনা যায়। (২৭) জ্যান্ত মাছে পোকা পড়ে না। ব্যাখ্যা: সতেজ মনে পাপ বাসা বাঁধতে পারে না। (২৮) অকর্মা নাপিতের ধামাভরা ক্ষুর। ব্যাখ্যা: অক্ষমতার দুর্বলতা ঢাকতে অকর্মারা বেশি ভড়ং দেখায়। (২৯) অন্ধকারকে অভিশাপ দেওয়া থেকে একটি প্রদীপ জ্বালানো ভাল। ব্যাখ্যা: কোন সমস্যা সম্পর্কে অভিযোগ না জানিয়ে সমস্যাটির সমাধানে সচেষ্ট হওয়া উচিত। (৩০) অকাল গেল সুকাল এল পাকল কাঁটাল কোষ, আজ বন্ধু ছেড়ে যাও, দিয়ে আমার দোষ। ব্যাখ্যা: অসময়ে উপকৃত হয়ে নানা অজুহাতে সুসময়ে উপকারীকে অস্বীকার করা।
সবশেষে নোয়াখালি অঞ্চলের একটি প্রবাদ বলে বিদায় নিচ্ছি- মা গেছে চাইর বার, হোলা গেছে তিন বার, আর একবার যাই ছা, আমরা কি হেতাগো, ভাতের কাতরিয়ানি ???