গ্যাসলাইটিং -অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ

Sep 12, 2024 - 20:50
Sep 12, 2024 - 20:24
 1  11
গ্যাসলাইটিং -অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ
গ্যাসলাইটিং -অদৃশ্য নিয়ন্ত্রণ

ঘটনা ১- রুদ্র নবম শ্রেণির একজন ছাত্র। অতি সাধারণ পরিবারের হাসিখুশি একটি ছেলে। তার উচ্চতা ক্লাসের অন্য ছেলেদের তুলনায় কম। সপ্তম/ অষ্টম শ্রেণির দিকে তার সমবয়সী অন্য সবার উচ্চতা অনেকটা বাড়লেও, তার নিজের খুব একটা বাড়েনি । নতুন বিড়ম্বনা হচ্ছে ক্লাসের সবার  চেহারায় একটু করে দাড়ি-গোঁফের আভা দেখা গেলেও, রুদ্রর চেহারা মসৃণ। এনিয়ে তার কাছের দুই বন্ধু প্রায় সারাক্ষণই ফোঁড়ন কাটে। ইদানিং সে একেবারেই বাসা থেকে বের হতে চায় না, খেলাধুলাও করে না, ক্লাসে পড়া বলে না। কথা বলার সময় তার মনে হয় তার গলা দিয়ে স্বর বের হতে চাচ্ছে না। শিক্ষকগণ তার উপর খুবই বিরক্ত।    

ঘটনা ২- অনার্স ২য় বর্ষের শুরুতেই তানিয়ার বিয়ে হয়ে যায়। সে বরাবরই একজন ভাল ছাত্রী। খুব বড় উচ্চাকাঙ্খা না থাকলেও আর্থিক দিক থেকে স্বাবলম্বী হওয়ার ইচ্ছে সে বরাবরই লালন করে আসছিল। ভাল পাত্র পাওয়ায় মা-বাবার অনুরোধ সে ফেলতে পারেনি। শ্বশুর বাড়ি থেকেও পড়াশোনার ব্যাপারে কোন প্রতিবন্ধকতা আসেনি।  কিন্তু পরিবারে তাকে সারাক্ষণই শুনতে হয় যে সে কোন কাজেই ভাল না। এতদিনের সংসারেও তার রুটি ফোলে না, ছাদে নেড়ে দেয়া কাপড় তোলা সহ কোন কাজই সে ঠিক ভাবে মনে রাখতে পারে না, খরচের হিসেব মেলাতে পারে না, এমনকি পোশাকের ব্যাপারেও তার রুচি ভাল না। এখন কোন সিধান্তই সে আর একা নিতে পারছে না। কদিন বাদেই তার অনার্স ফাইনাল। চাকুরীকরা দূরে থাক, সে এখন পাশ করাটা নিয়েই বেশ শঙ্কিত।

ঘটনা ৩- আফজাল সাহেব বছরখানের আগে এই কোম্পানিতে জয়েন করেছেন। এর আগে অন্য কোম্পানিতে একই পদে ছয় বছর চাকুরী করেছেন। এই কোম্পানিটা আগেরটার চাইতে বড় ও এর অফিস তার বাসা থেকে বেশ কাছে, তাই আগের চাকুরীটা ছেড়ে এখানে জয়েন করেছেন। তবে তার নতুন বস তার কারো কোন কাজেই সন্তুষ্ট নন। সারাক্ষণই সবার ভুল ধরেন। নানা কৌশলে সবার সামনেই একজনের ভুলত্রুটির রেফারেন্স অন্যজনের কাছে তুলে ধরেন। প্রায়ই হাসির ছলে বলেন – আপনার কগাছি চুল তো পাকা, হাত পাকা হবে কবে? সম্প্রতি ফাইল লেখার সময় অতি সাধারণ বানানও তাকে তার সহকর্মীর কাছ থেকে শুনে নিতে হচ্ছে। পরপর দুটা মোবাইল ফোন হারানোর কারণে গতকাল এক কমদামী বাটন মোবাইল ফোন কিনেছেন।

উপরের তিনটি ঘটনার ক্ষেত্রে একজন ব্যাক্তি বিভিন্ন বিরূপ মন্তব্য দ্বারা মানসিক ভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ইচ্ছেকৃতভাবে বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে আমরা অনেকেই এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হই, বা শিকার হতে দেখি এবং অনেক সময় নিজেরাই তাই করি। এটি সমাজের অতি পরিচিত একটি মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। যা কখনও প্রগাঢ় রূপ ধারন করতে পারে। এটি একটি ভয়ঙ্কর মানসিক নির্যাতন। এর নাম গ্যাসলাইটিং এবং শোষক ব্যাক্তিকে বলা হয় গ্যাসলাইটার। গ্যাসলাইটার ব্যাক্তি উদ্দেশ্য বিভিন্ন হতে পারে, কাউকে হেয় করা বা নিজের ক্ষমতা জাহির করা, নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা ইত্যাদি। গ্যাসলাইটিং শিকার ব্যাক্তি নিজের আত্মবিশ্বাস হাড়িয়ে ফেলেন, কখনো কখনও নিজেকে অপরাধী, দোষী বা ত্রুটি যুক্ত মনে করেন। এটা নারী, পুরুষ বা শিশু সহ সকলের ক্ষেত্রে হতে পারে। বর্তমান প্রযুক্তিগত উন্নয়নে আমাদের যোগাযোগের গণ্ডি দেশবিদেশ ছড়িয়েছে। ব্যাক্তিগত বা কাজের তাগিদে আমরা বিভিন্ন রকম মানুষের সঙ্গে পরিচিত হই, যাদের অনেকেই বেশ সংবেদনশীল । তাদের এই গ্যাসলাইটিং এর ঝুঁকি বেশী।

গ্যাস লাইটিং এর শিকার হলে আমাদের উচিৎ সেখান থেকে সরে আসা , কাছের কারো সঙ্গে খোলামেলা ভাবে আলোচনা করা, নিজের ভালদিক গুলো বিবেচনায় রাখা বা সরাসরি প্রতিবাদ করা ইত্যাদি। জীবনে আমরা নানা ক্ষেত্রে গ্যাসলাইটিং এর স্বীকার হতে পারি। এবং এর প্রভাবে আমাদের ব্যাক্তি জীবন, সামাজিক জীবন তথা কর্মক্ষেত্রকে দূষণে ভরে দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা WHO এর মতে স্বাস্থ্য হল ব্যক্তির শারীরিক , মানসিক এবং সামাজিক এই তিন অবস্থার একটি সুস্থ সমন্বয়। একটি সুস্থ ও সুন্দর জীবন সকলেরই প্রাপ্য । তাই আমাদের শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক সুস্থতার প্রতি যত্নবান থাকা উচিৎ।   আমরা নিজের জীবনে যেমন একজন গ্যাসলাইটার চাই না, তেমনি অন্যর জীবনেও গ্যাসলাইটার হব না। একটি সুন্দর পরিবেশ গড়ে তোলার লড়াইয়ে আমদের সবার অবদানই বজায় থাকুক । 

Files