গণতন্ত্র কী এখনও মূর্খদের শাসন? 

Oct 10, 2024 - 23:01
Nov 29, 2024 - 16:57
 0  68
গণতন্ত্র কী এখনও মূর্খদের শাসন? 
ছবি মারিয়া তাবাসসুম, ৮ম শ্রেণি, রোল:৩৯, শাখা:ড্যাফোডিল

রাজনীতি ছিল এক সময় রাজার নীতি। কিন্তু গণতান্ত্রিক আদর্শ একে আমজনতার আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের নীতিতে পরিণত করেছে। প্লেটো এক সময় গণতন্ত্রকে মূর্খদের সরকার বলে অবিহিত করলেও তার যুগ পেরিয়েছে দু হাজার বছর। সেকালে শিক্ষা কেবল  ব্যয়বহুলই ছিল না, দুষ্প্রাপ্যও ছিল। অনেক শিক্ষাগুরু আগ্রহীদের বিনামূল্যে শিক্ষা দিলেও সাধারণ মানুষের পক্ষে তা গ্রহণ করা ছিল বিলাসিতা। প্রোটাগোরাস নামের এক শিক্ষক/দার্শনিক শিক্ষাদানে ছাত্র প্রিতি দশ হাজার দ্রাকমা ( বর্তমানের ত্রিশ লাখ টাকা) গ্রহণ করতেন। এখনও বাংলাদেশের প্রাচুর্যশীল পরিবার ছাড়া সন্তানদের পিছনে এত টাকা ব্যয় করা সম্ভব না । ফলে, প্লেটোর যুগে রাজপরিবার, রাজার আমলা ও সামান্য কিছু অভিজাত পরিবারের সন্তান ছাড়া আমজনতার কেউ শিক্ষার সুযোগ পেত না। তাই, গ্রিসে প্রচালিত গণতন্ত্রকে প্লেটো সমালোচনা করতেই পারেন। আর তিনি নিজেও ছিলেন অভিজাত পরিবারের সন্তান। তাই অভিজাতদের প্রতি অনুরাগী প্লেটোর আমজনতার প্রতি বিরাগ থাকা অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু বর্তমান বিশ্ব প্লেটোর যুগের দুষ্প্রাপ্য শিক্ষা সুলভ হয়েছে। প্লেটোর সময় পশু পাখির চামড়ার উপর বই লেখা হত। কিন্তু কাগজ ও ছাপা খানা আবিষ্কারের পর জ্ঞান ও শিক্ষা সুলভ হয়ে পড়ে। বর্তমানের উত্তরাধুনিক যুগে মানুষের হাতের মুঠোয় সারা পৃথিবীর জ্ঞানভান্ডার সঞ্চিত থাকে।  তাই, একজন দিন মজুরের সন্তানও মোটামুটি শিক্ষিত হতে পারে, জ্ঞানের ঋষিতে পরিণত হতে পারে।

তাছাড়া কল্যাণকামী রাষ্ট্রে সার্বজনীন শিক্ষা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষারও বড় অংশ নামমাত্র মূল্যে প্রদান করা হয়। তাই বাংলাদেশের ভোটারদের এখন আর মূর্খ বলার কারণ নেই। তাছাড়া সরকার চালানোর জন্য ক্ষমতাসীন দলের হাতে অনেক স্বীকৃত পদ্ধতি থাকে। তারা চাইলে সংসদ সদস্যের বাইরেও টেকনোক্রাট ব্যক্তিদের মন্ত্রীর দায়িত্ব দিতে পারে। তাছাড়া সরকার পরিচালনার বড় অংশটি সম্পন্ন করে আমলাতন্ত্রসহ অন্যান্য  রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলো। এসব সংস্থায় তো আর অশিক্ষিত লোকের স্থান নেই। তাই গণতন্ত্র বর্তমানে সর্বাধিক অভিজ্ঞ ও শিক্ষিতদের দ্বারা পরিচালিত হতে পারে।

আমার মতে, গণতন্ত্রের প্রকৃত সৌন্দর্য লুক্কায়িত আছে নাগরিকদের মত প্রকাশ ও সমাবেশের স্বাধীনতায়।  প্রাচীনকালে মত প্রকাশ কেবল মৌখিক কিংবা পাথুরে গ্রন্থ প্রণয়নের মাধ্যমে হত। কিন্তু বর্তমান সাইবার যুগে একজন নিরক্ষর ব্যক্তিও তার মত দেশে বিদেশে অজস্র মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারে। গণতন্ত্র মানুষকে নির্ভয়ে তাদের মত প্রকাশে উদ্বুদ্ধও করে। নীরবে প্রকাশিত মতের প্রতি গুরুত্ব দেয়া না হলে মানুষ সম্মিলিতভাবে সভা-সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল আয়োজনের মাধ্যমেও তাদের মতকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে। অবাধ মিডিয়ার বদলৌতে মানুষের মতামতসমাজের সকল স্তরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা গণতন্ত্রহীন সরকার ব্যবস্থায় নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তারপরও বাংলাদেশে দুইটি গণতন্ত্র-বিমুখ গোষ্ঠী থাকতে পারে। এদের একটি সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট ঘরানার দলগুলোর কেউ এবং ধর্মীয় আবহকে পূঁজি করে রাজনীতি করার কোন কোন দল। অবশ্য  এদুই গোষ্ঠীকে ঢালাওভাবে আমি গণতন্ত্রবিরোধী বলছি না। কারণ সমাজতন্ত্রীদের মধ্যে যেমন অনেক ভাগ-বিভাগ রয়েছে, তেমনি ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা দলগুলোর মধ্যেও নীতির যথেষ্ঠ পার্থক্য রয়েছে। তাই এদের মধ্যেও গণতন্ত্রকে পূর্ণ সমর্থন করা থেকে শুরু করে গণতন্ত্রকে ‘কবর দেয়ার’ মানসিকতা সম্পন্ন গ্রুপও রয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষ কোন না কোনভাবে ব্রিটিশ আমলের শেষ শতক থেকে গণতন্ত্র চর্চা করে আসছে। বাংলাদেশের স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ দেশের সর্বপ্রাচীন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। মাঝে মাঝে কিছু ছন্দ পতন হলেও ইউনিয়ন পরিষদ তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র চর্চার প্রথম প্রতিষ্ঠান। এর বাইরেও জাতীয় পর্যায়ে আমরা গত পৌনে একশত বছর থেকে গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে আসছি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা স্বাধীনতার জন্য যে আন্দোলন ছিল তার সবগুলোই ছিল গণতান্ত্রিক মানসিকতা থেকে উদ্ভূত। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ আমাদের জাতির জন্য শ্রেষ্ঠ গণতান্ত্রিক বিপ্লব। এর পর কালে কালে বাংলার মানুষ যেসব আন্দোলন-অভ্যুত্থান করেছে, তার সবই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে পুনপ্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে। তাই বাংলার মানুষ গণতন্ত্র ভিন্ন অন্য কোন রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কোন দিনই মেনে নিবে না। হয়তো তাদের কিছুদিন স্তব্ধ করে রাখা যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসবেই।

অনেকে অভিযোগ করেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় আমাদের তো কোন উন্নতি হল না। আমি মনে করি, তারা প্রকৃত সত্য বলছেন না। কারণ স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পরে এখন যারা দেশকে গণতন্ত্র কিছু দিতে পারেনি, তারা আসলে নিজেদের বিশ বছর আগের অবস্থার সাথে তুলনা করেন, ১৯৭১ সালের সাথে নয়। যে দেশের মানুষ এক সময় দুবেলাও খেতে পারত না, একটার বেশি জামা যাদের গায়ে কখনও উঠত না। হাটে-বাজারে, শহরে-বন্দরে নাঙা গতরে ঘুরে বেড়াতেন, সেই মানুষগুলোই এখন খালি গায়ে বাড়ির বাইরে বের হন না, খালি পায়ে রাস্তায় ওঠেন না। এসব উন্নতি আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃশ্যমান হত যদি গণতান্ত্রিক ধারা অব্যহত থাকত।

তবে গণতন্ত্র কোন যাদুমন্ত্র নয় যে মুখে আওড়ালেই সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। এটা এমন একটি রাষ্ট্রশাসন পদ্ধতি যা নিরন্তর অনুশীলন করতে হয়।  অনুশীলনের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নুতনভাবে অনুশীলন শুরু করতে হয়। এই যে আমরা এখন গণতন্ত্র ব্যবস্থা ভাল নয় বলে যেখানে সেখানে মত প্রকাশ করছি, যদি গণতন্ত্রই না থাকত, তবে এমন কথা কেউ বলারই সাহস পেত না।

 জনগণের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভাসমাবেশ করার স্বাধীনতা যদি গায়ের জোরে স্তব্ধ করা হয়, তার পরিণামে দেশ সামনের দিকে নয়, পিছনের দিকে চলে। সাম্প্রতিক পতিত স্বৈরাচারের ভুলগুলো থেকে তাই আমাদের শিক্ষা নিতে হবে, আমাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রয়োজনমাফিক সংস্কার করতে হবে, প্রয়োজনে নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে হবে। গণতন্ত্র অবশ্যই ত্রুটিহীন কোন শাসন পদ্ধতি নয়, কিন্তু এর চেয়ে উত্তম ব্যবস্থা আমাদের জানা মতে পৃথিবৱীতে নেই।


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ৪ এপিবিএন স্কুল ও কলেজ অনলাইন জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা-পৃষ্ঠপোষক, ৪ এপিবিএন, বগুড়ার সাবকে অধিনায়ক। বর্তমানে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, মিরপুর, ঢাকা এর মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ।