কর্ষিত বেদনা
মুক্তিযুদ্ধে স্বৈরাচারী পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে যখন চূড়ান্ত বিজয় আসে, তখন পিঁপড়ার সারির মত দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে, প্রতিবেশী দেশ থেকে, সীমান্ত থেকে, পাহাড়, জঙ্গল, নির্জন অজ্ঞাতবাস থেকে বিচ্ছিন্ন, বিতাড়িত, নির্বাসিত মানুষ ফেরে আপন ঘরে।
পাওয়া-না পাওয়ার মিশেলী ক্ষণে খোঁজে প্রিয় ষাঁড়,গাভীন ছাগল,অকারণ লেজ নাড়ানো বিশ্বাসী কুকুর,গাই দোহনের শব্দে মিঞ মিঞ ডাকা বিড়াল অথবা দলছুট দুখী ছানাদের মা মুরগিটা। সবকিছুর বাইরে কলিজা খাক করা প্রিয় সন্তানের শূন্যতায় খুঁজে ফিরে সন্ধ্যা-সকাল.. অবিরত।
তবু শূন্য হাঁড়ির দাবির কাছে পুরুষ ছোটে প্রিয় জমিতে।চোখ ভরে দেখে অনাহারী শক্ত কঠিন মাটির বুক--দর দর করে জল পড়ে চোখ থেকে। বাঁচার আনন্দ না কষ্ট!বোঝা যায় না।
ফজর নামায শেষে সোবহান মন্ডলও লাঙল-জোয়াল আর ফিকে লাল রঙা,পাঁজর বের হওয়া দুটো গরু নিয়ে বের হয়।ইটের আধা ভাঙা রাস্তা ধরে যায় সাতকাঠার উঁচু ভিটায়। রাস্তার পাশে ভিটার দিকে মুখ রেখে দুটি প্রকাণ্ড শিমুল গাছ। একটি ঋজু দাঁড়িয়ে,অন্যটি বয়সের ভারে আধশোয়া অবস্থায়। শিমুল ফোটার সময় লাল পুষ্পবৃষ্টি পথ এবং সাতকাঠাকে রাঙিয়ে দেয় রুপবতী নারীর মত!একপাশে লম্বা সরু জোলা ডোবার সাথে মিশেছে।যেখানে চ্যাঙ-টাকি মাছের নির্বিঘ্নে বসত।পাশে অবহেলে বেড়ে ওঠা কদম বৃক্ষের বর্ষা মাতানো গন্ধে গন্ধময়ী ও বটে ভিটা!
দুর্বল জোড়াকে ক্রমাগত হুট,হাট শব্দে তীক্ষ্ণ লাঙল ফলা বসিয়ে বের করে নরম উর্বর। সোবহানের চোখে আবারও স্বপ্ন--ঢলঢল শস্যের হাসিমাখা সুখী সাতকাঠার। দেশটা আজ সত্যিই তার নিজের! শুকনো ঝুরা মাটির ঘ্রাণ টেনে নেয় বুকে। বারংবার চোখ ভিজে। বুকের ঘাম,চোখের জলে ভিজে মাটি। লাঙল সজোরে চেপে ধরে,গরুকে তাড়া দিতেই বের হয় হাঁটু পা!অস্বাভাবিক দৃশ্যে স্বাভাবিক সোবহান মন্ডল অন্য লোকদের ডাকে।বড় হয় জমায়েত।মাটি সরাতে অগভীর কবর থেকে বেরিয়ে আসে কাফনহীন পুরুষ লাশ! দেখতে তাজা,অক্ষত। শুধু ঘাড়ের কাছে একটি কালো দাগ। অপচন লাশ দেখে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয় গ্রামবাসী!সবার চেনা ভিনপাড়ার জোব্বার!স্বাধীনতার তিন-চার মাস আগে সোমবারের হাট থেকে ফেরার সময় হারিয়ে যায়।চটের ব্যাগে খুরমা, পারুটি-রসগোল্লা এবং তেল,নূন,ডালসহ রাস্তায় পড়ে থাকলেও তার দেখা মিলেনি। সেদিন পাকিস্তানি কসাইরা রক্ত পিপাসায় পাগল হয়ে চোখের সামনে যাকে দেখতে পায়, তাকেই ধরে নিয়ে যেয়ে হত্যা করে। সুদর্শন নীরিহ জোব্বার,সেই অশেষ নির্মম বলির শিকার!
প্রিয় বাবা ফেরার অপেক্ষায় ছয় বছরের ছোট পরী যতি, সাথে প্রিয় খাবার রসে ভেজা টুপটুপে পারুটি..। অপেক্ষায় নাজমা বেগম ও..
সম্মিলিত সিদ্ধান্তে নূতন করে দাফন,কবর হয়। কিন্তু কর্ষিত বেদনা বড় হয় সোবহান মন্ডলের সাতকাঠার গোপন গহীন ছাড়িয়ে নাজমা বেগম..যতি..পাড়া..গ্রাম.. বাংলাদেশের হৃদয়ে
...