উ জেতিয়েন: চীনের একমাত্র নারী সম্রাট

Feb 13, 2025 - 18:05
Feb 13, 2025 - 18:46
 0  15
উ জেতিয়েন: চীনের একমাত্র নারী সম্রাট
ছবি এডিটঃ সম্পা রানী সরকার

পৃথিবীতে অনেক নারী রাজ্য শাসন করেছেন। কিন্তু চীনের ইতিহাসে একজন মাত্র নারীর নাম জানা যায় যিনি পরিপূর্ণরূপে সম্রাটের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছেন। আমরা আজ সেই চীনা সম্রাজ্ঞীর গল্প শুনব।

আমাদের আলোচিত সম্রাজ্ঞী ইতিহাসে উ জেতিয়ান নামে পরিচিত। তার নামের অর্থ মহতী ও পবিত্র রানী। উ জেতিয়েনের জন্ম ৬২৪ সালে আজকের চীনের সিচুয়ান প্রদেশের লিঝাও জেলায়। তার পিতা উ হুও  ট্যাং সাম্রাজ্যের একজন জেনারেল প্রাদেশিক  গর্ভনর  ছিলেন।

অভিজাত ঘরের সন্তান হওয়ায় উ ছোটবেলা থেকেই বিদ্যাবুদ্ধিতে ছিলেন প্রখর মেধাবী। শিশুকালেই তাকে লেখাপড়ায় শিক্ষিত করে তোলা হয়। তিনি চাইনিজ ক্লাসিক সাহিত্য ও সঙ্গিতে পারদর্শি হয়ে ওঠেন। চৌদ্দ বছর বয়সে তাকে টাং বংশের প্রথম সম্রাট তাইজং অন্যতম উপপত্নী হিসেবে হেরেমে নিয়ে আসেন।

উ-কে রাজদবারে ‘কেইরেন’ বা পঞ্চম গ্রেডের উপপত্নীর মর্যাদা দেয়া হলেও তার প্রতিভাবলে তিনি দ্রুত সম্রাটের প্রিয়পাত্রী হয়ে ওঠেন। সম্রাট তাকে ‘মেইনাং’ বা ‘মোহনীয় নারী’ বলে ডাকতেন। শিক্ষিত হওয়ায় তাকে সরকারি নথিপত্র পড়াশোনার দায়িত্ব দেয়া হয় যা তাকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে পরিচিত হওয়ার সুযোগদান করে।

হেরেমখানায় প্রবেশের এগার বছরের মাথায় সম্রাট  তাইজং মারা গেলে রাজকীয় প্রথা অনুসারে উ জেতিয়েনসহ তার সকল উপপত্নীকে বাকী জীবন কাটানোর জন্য একটি বৌদ্ধ মঠে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কোনভাবেই তারা মঠের বাইরে আসতে পারত না।

সম্রাট তাইজং এর পর সম্রাট হন তার বড় ছেলে গাওজং। পিতার উপপত্নী হলেও গাওজং উ জেতিয়েনকে তার প্রতিভা ও রাষ্ট্রীয় কাজের অভিজ্ঞতার জন্য বিশেষভাবে পছন্দ করতেন। তাই মঠে যাওয়ার ছয় বছরের মাথায় ৬৫৫ সালে উ- কে গাওজং বৌদ্ধ মঠ থেকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসে দ্বিতীয় শ্রেণির উপপত্নীর ময়াদা প্রদান করেন।

উ দ্রুত নূতন সম্রাটের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করেন । তার গর্ভে সম্রাটের দুইটি পুত্র সন্তানের জন্মের পর তিনি এত বেশি উচ্চাকাঙ্খী হয়ে ওঠেন যে তিনি জ্যেষ্ঠতম উপপত্নী জিয়াওসু ও খোদ সম্রাজ্ঞীর সাথে প্রতিদ্বন্দীতায় লিপ্ত হন। উচ্চাকাঙ্খা পূরণার্তে তিনি জঘন্যতম প্রক্রিয়ার আশ্রয় গ্রহণ করেন। দুই পুত্র সন্তানের পর একটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করলে সে অল্পদিন পরেই মারা যায়। উ এ সন্তানের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড বলে প্রচার করে তার দায় খোদ রাজমহষী ওয়াঙ এর উপর চাপিয়ে দেন। উ এর উপর প্রচণ্ড আস্থাশীল সম্রাট এ অপরাধে তার প্রথম উপপত্নী জিয়াওসু ও সম্রাজ্ঞী ওয়াংকে মৃত্যুদণ্ড দেন। দ্বিতীয় শ্রেণির উপপত্ন উ-ই তখন একমাত্র ক্ষমতাধর হয়ে ওঠেন। ৬৫৫ সালে উ সম্রাজ্ঞীর মর্যাদায় উন্নীত হন। তার উচ্চাশার প্রথম পর্যায় বাস্তবে রূপ নেয়।

রাজমহিষী পদলাভ ও ক্ষমতা প্রয়োগে উ-এর দ্বিতীয় প্রতিবন্ধকতা ছিল রাজপ্রসাদের  উচ্চপদস্থ অভিজাত সম্প্রদায়। তাদের মতে, উ-র পিতা রাজ্যের একজন সিনিয়র সরকারি কর্মকর্তার কন্যা হলেও তার পরিবার অভিজাত শ্রেণির ছিল না। তার চেয়েও বড় কথা, উহু ছিল সম্রাট গাওজং এর পিতার উপপত্নী।  তাই ছেলে হিসেবে পিতার উপপত্নীকে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করা অজাচারের সামিল। তাই রাজ আমাত্যগণ রাজা ও রাজমষীর উপর নাখোস ছিল।

 ঊ খুব দ্রুত এসব আমলাদের বিরোধীতার মাত্রানুসারে চাকরিচ্যুত করেন, অনেককে দেশ ছাড়া করেন  এবং  অনেককে কৌশলে হত্যা পর্যন্ত করেন। তার স্বামীর বংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায়, এমনকি সম্রাট গাওজং এর  চাচাকেও গুপ্ত ঘাতকের দ্বরা হত্যা করেন। অন্যদের দেশছাড়া করেন। এভাবে ৬৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই  উ তার প্রাসাদের সকল প্রতিদ্বন্দ্বী ও বিরুদ্ধবদীদর নির্মূলপূর্বক নিজ ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করেন। সম্রাট গাওজং শারীরিক ও মানসিকভাবে দুর্বল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাই তার দীর্ঘ ২৩ বছর শাসনকালে তিনি নামে মাত্র সম্রাট ছিলেন। সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন সম্রাজ্ঞী উ জেতিয়েন। সম্রাট গাওজং ছিলেন অত্যন্ত ভীরু প্রকৃতির অদক্ষ শাসক। তিনি সব সময় শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকতেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন, উ তার স্বামীকে দীর্ঘদিন ধরে স্বল্পমাত্রার বিষ প্রয়োগে সারাক্ষণ অসুস্থ রাখতেন। 

অবশেষে ৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট গাওজং মৃত্যু বরণ করলে তার বড় ছেলে লি জিয়ান ঝংজং নামে সম্রাট হন। তবে মূল ক্ষমতা থেকে যায় জেতিয়েনর হাতে। অন্যদিকে সম্রাটের স্ত্রী তার শাশুড়ির মতো ক্ষমতা প্রয়োগের চেষ্টা করেন। বিষয়টি বুঝতে পেরে জেতিয়েন সম্রাট ঝংজংকে ক্ষমতাচ্যূত করে নির্বাসনে পাঠিয়ে দ্বিতীয় ছেলে লি ডাংকে (রুইঝং) নামমাত্র সম্রাট নিয়োগ করেন। কিছুদনি পর তাং সমর্থকগণ উ- এর বিরুদ্ধে অভ্যূত্থান করলে উ তা মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কঠোর হস্তে দমন করেন।

এবার উ এর বোধদয় হল যে পুত্রদের আনুষ্ঠানিক সম্রাট বানিয়ে পিছন থেকে ক্ষমতা প্রয়োগ নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করে। তাই স্বামীর মৃত্যুর মাত্র ছয় বছরের মাথায় ৬৯০ সালে ৬৫ বছর বয়সে উ তার দ্বিতীয় ছেলে সম্রাট রুইজংকে ক্ষমতাচ্যূত করে নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন। চীন ভূখণ্ডের ইতিহাসে তিনিই প্রথম ও শেষ নারী সম্রাট হিসেবে কোন প্রকার বিরোধীতা ছাড়াই আরও পনের বছর রাজ্য শাসন করেন। পূর্ণাঙ্গ সম্রাজ্ঞীর উপাধি হয় ‘জেতিয়েন’ যার অর্থ মহান ও পবিত্র সম্রাজ্ঞী।

রাষ্ট্রীয়ভাবে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হলেও জেতিয়েনের উত্তরসুরী নির্বাচন সংক্রান্ত বিশেষ সমস্যা ছিল। তিনি একে একে তার দুই সন্তানকে অযোগ্যতার দরুণ ক্ষমতাচ্যূত করে নির্বাসনে পাঠিয়েছেন। নিজ রাজবংশকে তিনি তার স্বামীর টাঙ বংশের পরিবর্তে পিতার উঝাউ পরিবাররূপে পরিবর্তন করেন। তাই তার ভাইয়ের দুই ছেলে সম্ভাব্য উত্তরাধিকারের প্রত্যাশা শুরু করে।

 কিন্তু এই ক্ষমতাবিলাশী নারীর মনে যে প্রকৃত কি ছিল তা কেউ বুঝতে পারত না। সবাইকে অবাক করে ৬৯৮ সালে জেতিয়েন তার বড় ছেলে ঝংজংকে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনে যুবরাজ ঘোষণা করেন। তবে বরাবরের মতোই যুবরাজ ছিলেন অন্তরালের ব্যক্তি।

জীবনের শেষ বছরগুলোতে সম্রাজ্ঞী জেতিয়েন তার ভাইয়ের ছেলেদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। তারা অশীতিপর সম্রাজ্ঞীকে সংকীর্ণ স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকেন। বিষয়টি জেতিয়েন জানলেও কিছু করতে পারতেন না। শারীরিক দুর্বলতা বাড়ার সাথে ভাতিজাদের দৌরাত্মও বাড়তে থাকে। 

এ পর্যায়ে জ্যৈষ্ঠ মন্ত্রী ও জেনারেলগণ অতিষ্ট হয়ে ৭০৫ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেতিয়েনকে ক্ষমতাচ্যূত করে জেতিয়েনের দুই ভাতিজাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে তার বড় ছেলে ঝংজং এর নিকট ক্ষমতা অর্পণ করেন। বৃদ্ধা জেতিয়েনকে প্রাণে না মেরে রাজপ্রাসাদ থেকে বিতাড়িত করে অন্য একটি প্রাসাদে ৃপাঠিয়ে দেয়া হয়। এভাবে পাঁচ বছর ক্ষমতাহীন থাকার পর সম্রাজ্ঞী ৭১০ সালে ৮২ বছর বয়সে  মৃত্যুবরণ করেন।

 উ জেতিয়েন একজন উপপত্নী থেকে নিজ যোগ্যতা, কৌশল ও দক্ষতা বলে চীন সম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞীর আসনে বসেছিলেন। তার সময় চীন অপেক্ষাকৃত শান্ত থাকলেও তিনি চীনের ছোট ছোট অনেক রাজ্যকে একীভূত করে চীন সম্রাজ্যের সীমা বহুগুণে বৃদ্ধি করেছিলেন। তিনি কৃষি থেকে শুরু করে সিভিল সার্ভিস নিয়োগ পরী্ক্ষা পর্যন্ত অনেক বিষয়ে আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন।তিনিই প্রথম  চীনদেশে সরকারি কর্মচারীদের নিয়োগ পরীক্ষায় ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারের সূচনা করেন।

 তবে তার ক্ষমতায় আরোহণ ও ক্ষমতাকে নিরুঙ্কুশ করার কৌশল ছিল অত্যন্ত নির্দয়। অনেক ঐতিহাসিকের মতে তিনি সম্রাট তাইজং এর স্ত্রী হওয়ার কৌশলরূপে তার একমাত্র কন্যা সন্তানকে নিজ হাতে হত্যা করে সে দায় সম্রাজ্ঞরি উপর চাপিয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। তিনি তার স্বামীকেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিলেন। আর নিজ ক্ষমতার জন্য হুমকী হতে পারে এমন সকল প্রতিদ্বন্দ্বীকে নির্দোষভাবে নিমূল করেছিলেন। এমনকি নিজ ছেলেরাও তার হাতে কম লাঞ্ছি হয়নি!

এত কিছুর পরেও সম্রাজ্ঞী উ জেতিয়েন পৃথিবীর রাজনৈতিক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র । তিনি রাজনীতি সচেতন আধুনিক নারীদের উচ্চাকাঙ্খার প্রেরণা হতে পারে।


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। তিনি ৪ এপিবিএন স্কুল ও কলেজ অনলাইন জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা-পৃষ্ঠপোষক, ৪ এপিবিএন, বগুড়ার সাবকে অধিনায়ক। বর্তমানে তিনি পুলিশ স্টাফ কলেজ, বাংলাদেশ, মিরপুর, ঢাকা এর মেম্বার ডাইরেক্টিং স্টাফ।