আরব জাতির উত্থান: এক বিষ্ময়কর ইতিহাস-পর্ব ৪

Jun 27, 2024 - 14:12
Jul 4, 2024 - 20:36
 0  23
আরব জাতির উত্থান: এক বিষ্ময়কর ইতিহাস-পর্ব ৪

আবু লুবাবা (রা)কে মদিনায় ফেরত পাঠানোর পর কাফেলার সাথে কত লোক আছে তা তিনি জানতে চাইলেন। সাহাবীগণ হিসেব করে বললেন যে, তাঁদের সাথে মাত্র তিনশত তেরজন সাহাবী রয়েছেন। রাসুল (স) আল্লাহর উপর ভরসা করে তাদেরকে নিয়েই তিনি আবার যাত্রা করলেন। সেখান থেকে আরও কিছুদূর অগ্রসর হয়ে বদরের  রাস্তা বামে রেখে পশ্চিম দিকে চলতে থাকলেন এবং নাযিয়াহ পর্যন্ত এগিয়ে গেলেন। সেখান থেকে রাহকান উপত্যকা অতিক্রম করলেন। এরপর সাফরার মেঠোপথ ধরে তিনি দাররাহ প্রান্তরে উপনীত হন। এই সময়ে তিনি তাঁর নিজস্ব গোয়েন্দা মারফত জানতে পারলেন যে, কুরাইশরা আবু সুফিয়ানকে সাহায্য করার জন্য সশস্ত্র অবস্থায় মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছে। এই খবর পাওয়ার পর রাসুল (স) চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কারণ, তিনি চেয়ে ছিলেন আবু সুফিয়ানের নিরস্ত্র কাফেলাকে আর তার পরিবর্তে পেয়ে গেলেন আবু জেহেলের নেতৃত্বে  পরিচালিত এক সশস্ত্র বাহিনীকে। তাও আবার সংখ্যায় নিজেদের চেয়ে তিন গুনেরও বেশি। জরুরী সভা ডেকে তিনি সাহাবীদের মতামত জানতে চাইলেন। প্রথমে হযরত আবু বকর (রা) দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী রাসুল (স) যা করবেন আমরা তার সাথে পূর্ণ একমত পোষণ করছি’। পরে উমর (রা) দাঁড়িয়ে একই কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। এবার রাসুল (স) আনসারদের দিকে তাকালেন। তাঁর চিন্তিত অবস্থা দেখে মদিনার আনসার সাহাবীদের মধ্যে থেকে মিকদাদ ইবনে আমর (রা) বললেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনি নিশ্চিত থাকুন যে, আমরা বনী ইসরাইলদের মতো হব না। যারা মুসা নবীকে বলেছিলেন ‘তুমি এবং তোমার আল্লাহ গিয়ে যুদ্ধ কর’। বরং আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে সাগরে ঝাঁপ দেন আমরাও আপনার সাথে সাগরে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আপনি যদি আমাদেরকে নিয়ে আগুনে ঝাঁপ দেন আমরাও আপনার সাথে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ব। আমরা কোনো অবস্থাতেই আপনাকে ত্যাগ করব না’। আরেক আনসার সাহাবী সা’দ ইবনে মুয়ায (রা) বললেন, ‘আমরা আপনাকে সত্য জেনে আপনার প্রতি ইমান এনেছি। যিনি আপনাকে সত্য রাসুল করে প্রেরণ করেছেন তাঁর শপৎ করে বলছি, আপনি যদি যুদ্ধ করতে করতে আবিসিনিয়ার বারকুল গিমাদ পর্যন্ত চলে যান তবে আমরাও আপনার সাথে সেখানেই যাব’। সাহাবীদের এমন মন্তব্যে রাসুল (স) সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁদের জন্যে দোয়া করলেন। পরক্ষণেই রাসুল (স) সাহাবীদেরকে ডেকে এই মর্মে সুসংবাদ দিলেন যে, মহান আল্লাহ তোমাদের প্রতি খুশি হয়েছেন। তাদের দুটি দলের একটির সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হবে এবং তারা খুব শীঘ্রই পরাভূত হবে। আমি যেন তাদের পতনের স্থানগুলো দেখতে পাচ্ছি’। রাসুল (স) এর এই সুসংবাদে সাহাবীগণ ইমানের বলে আরও বলিয়ান, আরও উজ্জিবীত ও  শহীদ হওয়ার জন্য পাগলপারা হয়ে গেলেন। কুরাইশদের খোঁজ খবর নেয়ার জন্য স্থানীয় জুহাইনা গোত্রের দু’জন লোককে বদরের প্রান্তর এবং তার আশে পাশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য প্রেরণ করা হলো। 

এদিকে আবু সুফিয়ান সিরিয়া থেকে বানিজ্য কাফেলা নিয়ে মক্কায় ফেরার পথে মদিনার সীমানার কাছাকাছি আসতেই মরূভূমির উপরে কয়েকটি উটের পদচিহ্ণ দেখতে পেলেন। তিনি সন্দিহান হলেন যে, এগুলো মদিনার টহল বাহিনীর উট কী না। উল্লেখ্য যে, মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার পর রাসুল (স) নিয়মিতভাবে মদিনার চর্তুদিকে টহলদার বাহিনী প্রেরণ করতেন। তারা দূর দূরান্ত পর্যন্ত সফর করতেন এবং পারিপার্শিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে রাসুলের নিকট তা বর্ণনা করতেন। যা হোক আবু সুফিয়ান উটের পদচিহ্ণগুলো পর্যবেক্ষণ করতে করতে কিছু উটের বিষ্টা দেখতে পেলেন। তিনি সেই বিষ্টার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে খেজুরের লম্বা ও চিকন আটি পেলেন। তিনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে, এই উটগুলো মদিনা থেকে এসেছে এবং তার কাফেলা মুহাম্মদ (স) এর গোয়েন্দা নজরদারীতে রয়েছে। যেকোনো সময়ে তিনি তাঁর বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে পড়বেন। আবু সুফিয়ান দ্রুতগামী উটের সাহায্যে মক্কায় এই মর্মে খবর পাঠালেন যে, ‘তোমাদের সম্পদ ও অস্ত্র লুট করার জন্য মুহাম্মদ আমাকে অনুসরণ করছে। কাজেই তোমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ‘বদর’ পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমাকে সাহায্য কর’। এই সংবাদ পাওয়া মাত্রই আবু জেহেলের নেতৃত্বে উতবা, সায়বা, অলিদ, উমাইয়াসহ মক্কার সকল নেতাগণ অল্প সময়ের মধ্যেই এক হাজার যোদ্ধা, যুদ্ধের অস্ত্রপাতি, মদ, নারী ও নর্তকীসহ গানবাজনা করতে করতে উর্ধশ্বাসে বদরের দিকে ছুটে চলল। কারণ এই বানিজ্য কাফেলায় আরবের সকল গোত্রের কম বেশি বিনিয়োগ ছিল এবং অন্যদের অন্তরে নাখলায় আমর ইবনে হাদরামীর মৃত্যুর প্রতিশোধ স্পৃহা দাউ দাউ করে জ¦লছিল। কুরাইশদের অন্তরে সেই ক্ষতচিহ্ণ তখনও শুকায়নি। তারাও সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বদলা নেয়ার জন্য।
মক্কায় এই খবর প্রেরণের পর আবু সুফিয়ান নিজের বুদ্ধিমত্তা খাটিয়ে সিরিয়া হতে বদরে যাওয়ার প্রচলিত রাস্তা পরিহার করে পশ্চিমের দিকে সরে যান এবং লোহিত সাগরের উপকূল ধরে অতি সাবধানে এগুতে থাকেন। এক সময় মদিনার সম্ভাব্য আক্রমন এলাকা পাশ কাটিয়ে চলার পর তিনি আবারও কুরাইশদের সংবাদ পাঠালেন যে, ‘তোমাদের কাফেলা আপাতত বিপদমুক্ত। তাই তোমরা এখন ফিরে আসতে পারো’। কিন্তু উতবা, সায়বা, অলিদ ও উমাইয়াসহ অন্যান্য নেতাগণ ফিরে যেতে চাইলেও আবু জেহেল ছিল একাট্টা। সে বলল, ‘আমরা যুদ্ধের জন্যে মক্কা থেকে বের হয়ে এসেছি। এখন যুদ্ধ না করে মক্কায় ফিরে যাব না। আমরা বদরের প্রান্তর পর্যন্ত যাব এবং মুহাম্মদের বাহিনীকে ধ্বংশ করব। তারপর সেখানে উট জবাই করে খাওয়া দাওয়া করব। মদ খাবো, গানবাজনা করব এবং নর্তকীদের নিয়ে তিন দিন ধরে আনন্দ ফূর্তী করব। তারপর আমরা মক্কায় ফিরে আসব’। তাই তারা বদরের দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখল।
রাসুল (স) যে দু’জনকে বদর এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় খোঁজ খবর নেয়ার জন্য প্রেরণ করেছিলেন, তারা এসে খোঁজ খবর নিয়ে কোনো কাফেলার সন্ধান পেলেন না। তখন তিনি সাহাবাদের নিয়ে এক সন্ধ্যাবেলায় বদরের সন্নিকটবর্তী পাহাড়ী এলাকায় এসে আত্মগোপণ করলেন এবং মাঝে মাঝে দু’একজন করে পাহাড় থেকে নেমে এসে ছদ্দবেশে কুরাইশদের কাফেলার খোঁজ খবর নিতে থাকলেন। কারণ ইতোমধ্যেই মহান আল্লাহ তাঁকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, দু’টি কাফেলার মধ্যে একটির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হবে। কাজেই তিনি সেই কাফেলার সাথে সাক্ষাতের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।  (চলমান)

তথ্য:

১.    History of the Arabs by Philip K.Hitti ভাষান্তর প্রিন্সিপাল ইবরাহিম খাঁ।

২.    সভ্যতার দ্বন্দ্ব ও আগামী দিনের পৃথিবীতে ইসলাম-আবদুল মান্নান আসযাদ।

৩.    খলিফাদের সোনালি ইতিহাস- সাইয়েদ আব্দুল কুদ্দস হাসেমি ভাষান্তর নূর হোসাইন উমর।

৪.    আর রাহিকুল মাকতুম-আল্লামা ছফিউর রহমান মোবারকপুরী, ভাষান্তর খাদিজা আকতার রেজায়ী।

৫.    বিশ্বনবী - গোলাম মোস্তফা।

৬.    ইন্টারনেট (উইকিপিডিয়া)।


মোঃ আবদুল জলিল Assistant professor- Dept of Mathematics Armed Police Battalion public School and College