অন্তরভেদী আখ্যানের রূপকার হান কাঙ
ফি-বছর অক্টোবর মাসে উৎকণ্ঠিত হয় বিশ্বের বিদগ্ধজন। এ মাসে পৃথিবী সম্মানীয় নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষিত হয়। ধারাবাহিক নিয়মে এ বছর সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার ঔপন্যাসিক হান কাঙ। সাহিত্যে সর্বশেষ নারী হিসেবে নোবেল জিতেছেন ফরাসী লেখিকা ‘আ্যানি ইম’ ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে। হান কাঙ ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নিয়মিত লিখে চলেছেন। তিনি ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ‘দ্য ভেজেটারিয়েন’ উপন্যাসের জন্য ‘ম্যান বুকার’ পুরস্কার পান। ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে এ গ্রন্থটি রচিত হলেও এর ইংরেজি অনুবাদ হয় ২০১৫ খ্রি.। ২০২৪-এর নোবেল একাডেমী সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে হান কাঙে’র পুরস্কার প্রাপ্তির কারণ হিসেবে উল্লেখ করে-‘তার নিবিড় কাব্যময় গদ্যভাষ পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় ইতিহাসের সত্যের মুখোমুখি, এ মানব জীবন কতটা ভঙ্গুর উন্মোচিত করে সেই সত্য।’
সাহিত্যের ছাত্রী কাঙ এর লেখক জীবন শুরু হয় ১৯৯৩ সালে কবিতার মধ্য দিয়ে। পরের বছর একটি ছোটগল্পের মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম ছোটগল্প সংকলন প্রকাশিত হয়। উপন্যাস ছাড়াও তিনি কবিতা,নভেলা,প্রবন্ধ ও গল্প লিখেছেন। লেখার মূল প্রতিপাদ্য হিসেবে তাঁর লেখায় স্থান পেয়েছে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, ও মানবিকতা। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নেওয়া হান কাঙ নারী জীবনের বিপন্ন পরিস্থিতি প্রতীকী বিষয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর রচনায় প্রতিফলিত করেছেন। শক্তিশালী এ লেখকের লেখার অন্তর্নিহিত তাৎপর্য প্রসঙ্গে পুরস্কার কমিটির প্রধান আন্ডারসন অলসন বলেছেন-‘শরীর ও আত্মার সংযোগ,জীবিত আর মৃত,কাব্যিকতা আর নিরীক্ষাধর্মী রচনাশৈলীর কারণে তিনি এই সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিক।’ একটি সাহিত্য পরিবারের পটভূমি থেকে হান কাঙ লেখালেখি প্রতি অনুরাগী হয়ে ওঠেন।
বাবা হান সিউংয়ুন একজন ঔপন্যাসিক। উপন্যাস ছাড়াও তাঁর অনুরাগের বিষয় চিত্রকলা ও সংগীত। উল্লেখ্য রক্তে পাওয়া বাবার সাহিত্য বোধ এবং সমকালের বিরূপ প্রতিবেশ হান কাঙ এর প্রতিভার অন্তর্গত ঐক্য হিসেবে কাজ করেছে। জীবনে প্রথম যে একগুচ্ছ কবিতা প্রকাশ হয়,‘লিটারেচার আ্যান্ড সোসাইটি’ সাময়িকীতে। তারপর থেকে সৃষ্টি ভূমিতে মেধা-মনন বীজ একের পর এক বুনে চলেছেন সাহিত্যের উঠানে। হান সবথেকে বেশি লিখেছেন উপন্যাস। প্রথম উপন্যাস ‘ব্লাক ডার’ প্রকাশের পর থেকে লিখে যাচ্ছেন একের পর এক উপন্যাস। তাঁর আলোড়িত উপন্যাস ‘দ্য ভেজেটিরিয়ান’ তিন পর্বে বিভক্ত। বইয়ের মধ্যে এ তিনটি গল্প যথাক্রমে--নিরামিষভোজী,মঙ্গোলিয়ান দাগ ও জাজ্বল্যমান গাছেরা। উপন্যাসের শুরু হয়েছে এক পুরুষের বয়ানে- `Before my wife turned vegetarian I’ d always thought for her as completely unremarkable in every way.’ এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দুইজন নারী। তাদের একজন ইয়ং হাই। যে ছোটবেলা থেকে সামাজিক জীবনে অভ্যস্ত। কিন্তু জীবনের এক পর্যায়ে এসে সে সামাজিক অসংগতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠে।
তারপর থেকে সে প্রতিজ্ঞা করে সামাজিক প্রথার বাইরে থাকার। এক পর্যায়ে ইয়ং হাই খাদ্য অভ্যাস তথা মাংস ভক্ষণ থেকে নিজকে বিরত রাখে। নিয়ম না মানার এই জেদের উপর উপন্যাসটির প্লট বিন্যস্ত হয়েছে। মানুষের নির্দয় কার্যবলাপ পরিহার তথা প্রথা অস্বীকার করে ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়েছে ইয়ং। কিন্তু সামাজিক বিধান লঙ্ঘন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনা। ফলে প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করতে গিয়ে সে সহিংস পরিণতির শিকার হয়। তারপর কথক হিসেবে হাজির হয় জামাইবাবু ও তার দিদি করমশ। একে একে কাহিনীতে ওঠে আসতে থাকে পরিবারের জটিলতা, অবদমিত কাম ও শিল্প চেতনার দ্বন্দ্ব। অসুস্থ নারী ইয়ং মনে করে সে আদৌ মানুষ নয়। ধীরে ধীরে গাছে পরিণত হতে থাকা এ নারী যেন অন্য এক মেটামরফোসিস। ‘নাগরিক কুটিলতা আর উপকথাসুলভ সারল্য, দুইয়ের সংঘাতে তৈরি হওয়া এক নতুনতর টেক্সট।’ ইয়ং হাই এর করুণ পরিণতি লেখকের হাতে কাব্যময় ও পরীক্ষামূলক গ্রন্থণ শৈলীতে শিল্পীতা পেয়েছে। লেখকের একটি ভিন্নমাত্রার উপন্যাস ‘ইউর কোল্ড হ্যান্ডস’ (২০০২)। এ উপন্যাসে মানব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও ব্যক্তিত্বের মধ্যে দ্বন্দ্বের নিদারুণ রূপ চিত্রিত হয়েছে ।
হান কাঙ এর প্লট ভিত্তিক উপন্যাস ‘দ্য ওয়ান্ড ব্লোস,গো। এটি ২০১০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। উপন্যাসের মধ্যে বন্ধুত্ব ও শৈল্পিকতার জটিল সমীকরণ পরিলক্ষিত হয়। কাহিনীর গতি প্রবাহ চরিত্রগুলোর মধ্যকার বন্ধুত্ব ও আকাঙ্ক্ষাকে একে অন্যের পরিপূরক করে তুলেছে। ২০১১ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘গ্রীক পাঠ’। এটি অনূদিত হয় ২০২৩ খ্রিস্টাব্দে। বাকশক্তি হারানোর পথে এক নারী প্রাচীন গ্রিক ভাষা শিখতে একজন পন্ডিতের সান্নিধ্যে আসেন। নিয়মিত পাঠ দীক্ষার মধ্যেই তাদের ভেতর সহজাত আবেগ জাগ্রত হয়। জৈবিক বাসনায় পরাস্ত দুর্বল দুজন মানব-মানবীর সম্পর্ক উচ্চমাত্রায় ধাবিত হয়। ঔপন্যাসিক মানব চরিত্রের দুর্গম রহস্যের জটিল মনস্তাত্ত্বিক দিকটি চিত্রায়ণ করেছেন উপন্যাসে। কাহিনী কার্যকারণ সূত্রে সামনে এগিয়ে যায় পাঠদানকারী শিক্ষকটি শিক্ষার্থীর মত দৃষ্টিহীন হতে শুরু করলে। গল্পের গাঁথুনি দুজন মানুষের ভালোবাসার সদর্থক পরিণতির প্রেক্ষিতে অবয়ব পেয়েছে। আমরা জানি ভালোবাসার মধ্যে লুকিয়ে থাকে আশাবাদী ও মানবীয় বিশ্বাস। এখানে গুরু-শিষ্যের একে অপরের প্রতি ঘনিষ্ঠ হবার ভেতর দিয়ে শুধু সুখ নয়, উভয়ে তাদের মানসিক যন্ত্রণা ও দুশ্চিন্তারও অংশীজন হয়েছে।
‘দ্য হেয়াইট বুক’ উপন্যাসটি ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে দক্ষিণ কোরিয়াতে প্রকাশিত হয়। উপন্যাসের পটভূমিতে স্থান পেয়েছে যুদ্ধ পরবর্তী পোলান্ডের ওয়াশা নগর। গল্পে নিরস্ত্র কথকের ছোট বোনের মৃত্যু সম্পর্কিত খণ্ড খণ্ড চিন্তামগ্নতা নিয়ে এর কাহিনীকে শিল্পরূপ দিয়েছেন হান কাঙ। ‘দ্য হোয়াইট বুক’-উপন্যাসের অনন্য দিক এর উপস্থাপন শৈলীর অভিনবত্ব। মানুষের বেঁচে থাকার অনিবার্য অনুষঙ্গ দুঃখ,ভাত,চিনি,কুয়াশা এবং বুকের দুধসহ ৬৫টি বস্তুর বর্ণনা করেছেন। লেখকের শৈববের বাহিত জীবন সাদৃশ্য এখানে খুঁজে পাওয়া যায়। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত উপন্যাস ‘হিউম্যান আ্যক্টস’। দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়াংজুতে ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর ভিত্তিতে এটি নির্মিত।
এর কাহিনী পিনবদ্ধ হয়েছে আন্দোলনে নিহত একটি ছেলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। উপন্যাসটি ন্যারেটিভ হয়েছে মন্থর প্রবাহে। এখানে স্বৈরাচারের বিপক্ষে কোনো প্রতিবাদ নেই। বরং তিনি নির্বিকারভাবে বর্ণনা করেছেন যন্ত্রণাময় দিনের কথা। সাতটি অধ্যায়ে উপন্যাসের গঠনে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মনোভূমি আন্দোলিত হয়েছে। ‘দ্য ফ্রট অব মাই উইম্যান’ ১৯৯৭ খ্রি. প্রকাশিত উপন্যাস। আটটি কাহিনীকে একত্র করে সৃষ্টি উপন্যাস। প্রতিটি পর্বে মানুষের পারস্পরিক সম্পর্কের ব্যর্থতাকে রেখায়িত করা হয়েছে। প্লটের গতি পরিক্রমায় প্রায় প্রতিটি চরিত্রকে আশাহীন হয়ে দিনাতিপাত করতে দেখা যায়। কিন্তু কেউ জীবন সংগ্রামে হার মানতে প্রস্তুত নয়। চরিত্রগুলোর এই দৃঢ়তা উপন্যাসটিকে একটি বিশেষ মাত্রা এনে দিয়েছে। উপন্যাসের ‘মাই উইম্যানস ফ্রট’ অংশে হতদরিদ্র জেলেপাড়ায় জন্ম নেয়া এক নারী নিজের চেষ্টায় বিশ্ব পরিব্রাজক হতে চায়।
তার এ পরিকল্পনার জন্য বিয়ে সহায়ক হবে ভেবে সে একদিন বিয়ে করে বসে। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যে স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন সৃষ্টি হলে সংসার ছেড়ে যায়। তারপর থেকে সে নিজের বাসনা পূরনের জন্য গাছ-লতা-পাতা হয়ে ঘরের ছাদ পেরিয়ে নিজের ইচ্ছা চরিতার্থ করার স্বপ্ন বুনতে থাকে। লেখক চরিত্রটির এই কর্মপ্রেরণার মধ্য দিয়ে পরাবাস্তবতার প্রকরণটি ব্যবহার করেছেন সযত্নে। আধুনিক জীবনের নিরাশাকে জয় করার প্রত্যয় এ চরিত্রটির একটি উজ্জ্বল প্রান্ত। নোবেল কমিটি হান কাঙ এর লেখার মধ্যে কাব্যিক স্বাদ অনুভব করার বিষয়টি উল্লেখ করেন। বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। দুটি উপন্যাস থেকে উদ্ধৃতি হতে সে কথার যথার্থতা মিলে ‘দ্য ভিজিটিরিয়ান’ এর ইয়ং হাই হিংসার ঊর্ধ্বে ওঠার ইচ্ছায় স্বপ্নে ভেবে চলে-‘ I like my breasts, nothing can be killed by them,Hand, foot,tongue,gaze,all Weapons from which nothing is safe, But not my breasts.’ আবার ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’` এ জীবন-মৃত্যুর মুখে দাঁড়ানো বালকটি ভাবছে-How long do souls linger by the side of their bodies? Do they really flutter away like some kind of bird? Is that what trembles the edges of the candle flame?’
হান কাঙ এর ‘উই ডু নট পার্ট’ উপন্যাসটি ২০২৫ খ্রি. জানুয়ারিতে প্রকাশিত হবে। প্রাণীর প্রতি মানবিক প্রেম এ উপন্যাসের মূল বিষয়। কাহিনীতে দেখা যায় শীতের এক সকালে কিউংহা সিউন একটি হাসপাতালে। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সে আজ শয্যাশায়ী। নিজের অসুস্থতার মধ্যে বাড়ির পোষা পাখির না খেয়ে মারা যাবার চিন্তায় সে উদ্বিগ্ন। প্রিয় পাখির মৃত্যৃচিন্তা তাকে বড্ড অস্থির করে। বন্ধু ইনলেনকে তাই ডেকে পাঠায় হাসপাতালে। কিন্তু পথে ঝড়ের মধ্যে আটকা পড়ে ইনলেন বন্ধুর কাছে পৌঁছাতে পারে না। কিউহার মনে দুর্ভাবনা বাড়তে থাকে। নিজের অসুস্থতার মধ্যে প্রাণীর প্রতি কিউংহার এই মানবিক বোধ পাঠকের মনেও ব্যাপক প্রতিক্রিয়া জাগায়।
বিশ্বের মানুষ এখন মানবতা, প্রেম ও মমতা থেকে যোজন যোজন দূরে। এমনি স্পর্শকাতর মুহূর্তে পশুর জন্য কিউংহার এই অনুরাগ আমাদের সামনে এক অনন্য মানবিক জগতকে উন্মোচিত করে। একইসঙ্গে ঔপন্যাসিক জীবনবাস্তবতার প্রকৃত কাহিনী নির্মাতা হিসেবে বিরলপ্রজ হয়ে ওঠেন। অসামান্য লেখকদের সূক্ষ্ম মানবিক বোধ এবং সামাজিক দায় তাঁকে নিরন্তর নতুন সৃষ্টিতে নিমগ্ন করে। বিক্ষুব্ধ সময় সংবেদনশীল হৃদয় স্পর্শ করলে নিরীক্ষাধর্মী কাহিনী নির্মাণে লেখক মাত্রই এগিয়ে আসেন। হান কাঙ সে ধারায় একজন শক্তিশালী লেখক। যাঁর লেখার ভেতর সততা উঁকি দেয় মানবিক সংকট, বেদনা, ক্ষত, বিপদ ও বিচ্ছিন্নতা। আর এসব নিয়েই তার উপন্যাসের ভূগোল। যেখানে তাঁর লেখারা এক ক্রান্তিকালের, এক যুগসন্ধির সন্ধান করে। রবীন্দ্রনাথের ১১০ বছর পর এশিয়ান নারী লেখক হিসেবে এবার সাহিত্যে নোবেল পেলেন হান কাঙ। লেখকের এই অর্জন তাই আমাদের গঠিত করে, প্রাণিত করে এবং ভেতরের বিবেককে করে শুভ্র আলোয় উজ্জীবিত। দীর্ঘায়ু হউন হান কাঙ।
আকরগ্রন্থ
ক. দ্য ভেজেটিরিয়ান-প্রকাশক- হোরাথ লনডন, ইংরেজি অনুবাদ-২০১৬
খ. হিউম্যান আ্যাক্টস-প্রকাশক- হোরাথ লনডন, ইংরেজি অনুবাদ-২০১৫
গ. দ্য হোয়াইট বুক- প্রকাশক-ঐ, প্রকাশকাল- ২০০২
ঘ. ইউর কোল্ড হ্যান্ডস-প্রকাশক-ঐ, প্রকাশকাল-২০০২