নবাব ফয়জুন্নেসা:সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজসেবায় অন্যন্যা নারী

সমাজসেবায় অন্যন্যা নারী

May 20, 2024 - 15:32
May 21, 2024 - 15:34
 6  61
নবাব ফয়জুন্নেসা:সাহিত্য, সংস্কৃতি ও সমাজসেবায় অন্যন্যা নারী

ঊনবিংশ শতাব্দীতে বঙ্গভারতে  সমাজসেবা ও শিক্ষা বিস্তারে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের প্রায় সবাই অমুসলিম ও পুরুষ। কিন্তু সে যুগেও একজন মুসলিম নারী জমিদার তার প্রজাদের অগ্রগতি ও মঙ্গলের জন্য নিজের সহায়, শ্রম ও অর্থ সম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। এই মহিয়ষী নারীর নাম নওয়াব ফয়জুন্নেসা।  আমরা এ পর্বে নবাব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর গল্পই শুনব।

 

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ কোম্পানি শাসনামলে তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার (আজকের কুমিল্লা) হোমনাবাদ পরগণা তথা আজকের লাকশাম উপজেলার পশ্চিমগাও গ্রামে একটি জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আহমেদ আলী চৌধুরী ও মায়ের নাম আফরুন্নেসা। তার পূর্বপুরুষগণ দিল্লির সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে হোমনাবাদ পরগণার জমিদারীর সনদ লাভ করেছিলেন। ফয়জুন্নেসার বড় দুই ভাই ও ছোট দুইজন বোন ছিলেন।

ফয়জুন্নেসার জন্ম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আধুনিক রূপকারদের সমসাময়িককালে। বাংলা বর্ণমালার প্রমিতকারী ঈশ্বরচন্দ বিদ্যাসাগরের জন্ম তাঁর জন্মের মাত্র চৌদ্দ বছর আগে (১৮২০)। বাংলা আধুনিক মহাকবি মাইকেল মধুসুধনের জন্ম তার জন্মের দশ বছর পূর্বে (১৮২৪ সালে)। বাংলা উপন্যাসের রূপকার বঙ্কিমচন্দ্র আর ফয়জুন্নেসার জন্মের সময়ের পার্থক্য মাত্র দুই বছর। আর বাংলা সাহিত্যের মহীরূহ রবীন্দ্রনাথ জন্মেছিলেন ফয়জুন্নেসার জন্মের সিকি শতাব্দী পরে (১৮৬১সালে)। তাই ফয়জুন্নেসার জীবন ও কর্মকালে বাঙালি সমাজ পুনর্জাগরণের শৈশবকাল পার করছিল। তিনি ছিলেন পুনর্জাগরণের অন্যতম পথিকৃত।

ঐতিহাসিকভাবেই ফয়জুন্নেসার প্রথম জীবন ছিল বাঙালি সমাজের নিরক্ষরতার মধ্যযুগ। ঐ সময় বাংলায়, বিশষত পূর্ববঙ্গে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছিল না বললেই চলে।  তাই বাল্যকালে ফয়জুন্নেসার কোন আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিল না। তবে বাড়িতে তিনি গৃহশিক্ষকদের কাছে বাংলাসহ আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষায় গভীর জ্ঞানার্জন করেন। কেবল ভাষা ও সাহিত্য নয়, তিনি সঙ্গীতেও পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করেছিলেন।

১৮৬০ সালে বাউসারের জমিদার সৈয়দ মুহাম্মদ গাজী চৌধুরির সাথে ফয়জুন্নেসার বিবাহ হয়। তিনি স্বামীর দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর দুজন কন্যা সন্তানও ছিল। হয়তো পুত্র সন্তানের আশাতেই গাজী সাহেব অনেক কাঠখড়ি পুড়িয়ে ফয়জুন্নেসাকে বিয়ে করেছিলেন। তবে ফয়জুন্নেসার বিবাহ সুখের হয়নি। মাত্র সাত বছর ঘর সংসার করে সতিনের অত্যাচারে অতিষ্ট ফয়জুন্নেসা ছোট মেয়ে বদরুন্নেসাকে নিয়ে পিতৃগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তার স্বামী ঊত্রিশ বছর বেঁচে থাকলেও স্বামীর সাথে তার দ্বিতীবার সাক্ষাৎ ঘটেনি। 

 ১৮৮৩ সালে পিতার মৃত্যুর পর ফয়জুন্নেসা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার প্রথম নারী হিসেবে পশ্চিমগাঁও-এর জমিদারী লাভ করেন।এর দুবছর পরে মায়ের মৃত্যুর পর তিনি নানার সম্পত্তিরও একাংশ লাভ করেন। সব কিছু মিলে ফয়জুন্নেসা বাংলার সবচেয়ে প্রাচুর্যশীল এক জমিদারীর মালিকে পরিণত হন।

আনুষ্ঠানিকভাবে জমিদারী লাভের অনেক আগেই ফয়জুন্নেসা সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য ১৮৭৩ সালে তিনি কুমিল্লায় যে বালিকা বিদ্যালয়টি স্থাপন করেন তা ব্রিটিশ ভারতের প্রাচীনতম বিদ্যালয়গুলোর অন্যতম। তিনি এই বিদ্যালয়ে নিজেই শিক্ষকতা করতেন। বর্তমানে স্কুলটি সরকারি কলেজে রূপান্তরিত হয়েছে। 

তিনি তার জমিদারির ১৪টি মৌজার প্রতেকটিতে একটি করে বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। বিদ্যালয়ে নারীদের উপস্থিতি বৃদ্ধির জন্য তিনি তাদের বৃত্তিপ্রদান ও ফ্রি আবাসিক হোস্টেলও চালু করেছিলেন। নিজে ইংরেজি না জানলেও ইংরেজি শিক্ষার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল ফয়জুন্নেসার । ১৮৭৬ সালে কুমিল্লা শহরে তিনি একটি ইংরেজি স্কুলও চালু করেছিলেন।

প্রজাদের সুচিকিৎসার জন্য তিনি অনেক হাসপাতালও স্থাপন করেছিলেন। নারীদের বিশেষ সুবিধার জন্য তিনি ১৮৯৩ সালে  ‘জেনানা হাসপাতাল’ নামে একটি পৃথক চিকিৎসা সেবা কেন্দ্রও চালু করেছিলেন।

ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী সমাজসেবা ও জনকল্যাণে মুক্তহস্তে অর্থ খচর করতেন। স্থানীয় উন্নয়ন ব্যয় মেটানোর জন্য সরকারি বাজেট আসতে দেরি হলে ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট স্থানীয় জমিদারদের কাছ থেকে কিছু অনুদান সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হলে ফয়জুন্নেসা একাই জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের উন্নয়ন তহবিলে এক লাখ টাকা দান করেছিলেন।

 জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. ডগলাস এ অনুদানসহ তার অন্যান্য সমাজসেবমূলক কর্মকাণ্ডের বিবরণ রানী ভিক্টোরিয়ার দরবারে প্রেরণ করলে রানী তাকে ‘বেগম’ উপাধিতে ভূষিত করেন। কিন্তু ফয়জুন্নেসা এ উপাধি গ্রহণে অস্বীকার করে বলেন, তিনি ইতোমধ্যেই তার এলাকার মানুষের কাছে ‘বেগম’ নামে পরিচিত। তাই নূতন করে তাকে ‘বেগম’ বলার কোন কারণ নেই। বিষয়টি অনুসন্ধানপূর্বক ব্রিটিশ রানী ১৮৮৯ সালে একটি অনাড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে হীরকখচিত পদক, রেশমি চাদর ও একটি সার্টিফিকেটসহ  ফয়জুন্নেসাকে ‘নবাব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ব্রিটিশ ভারতে তিনিই প্রথম নারী ‘নবাব’।

ফয়জুন্নেসা শিক্ষা ও চিকিৎসাক্ষেত্রে অর্থদানের বাইরেও সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রসারেও প্রচুর দানখয়রাত করতেন। তিনি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা প্রকশ’ ‘বন্ধু’, ‘সুধাকর’, ‘ইসলাম প্রচারক’ প্রভৃতি বাংলা পত্রপত্রিকা পরিচালনার জন্য নিয়মিত অর্থ সহায়তা দিতেন।

ফয়জুন্নেসা একজন বিদগ্ধ পাঠক ও লেখক ছিলেন। তার লিখিত আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘রূপজালাল’ (প্রকাশ ১৮৭৬ সাল) ভারতের মুসলমান নারী কর্তৃক রচিত প্রথম উপন্যাস। স্বামীগৃহ ত্যাগ করার পর তার সাথে স্বামীর বাস্তবে সাক্ষাৎ ঘটেনি। কিন্তু তিনি তার একমাত্র উপন্যাস ‘রূপজালাল’ স্বামীর নামেই উৎসর্গ করেছিলেন। উপন্যাস ছাড়াও সঙ্গীতের উপর দুইখানাসহ মোট চারখানা পুস্তক লিখলেও রূপজালাল ব্যতীত অন্য পুস্তকগুলোর অস্তিত্ব এখন নেই। 

পূর্ব বাংলার বাইরেও নবাব ফয়জুন্নেসার বুদ্ধিবৃত্তিক যোগাযোগ ছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের আলোকিত নারী সদস্যগণ নারী জাগরণের অংশস্বরূপ ‘সখী সমিতি’ নামে একটি বিশেষ নারীসংগঠন  তৈরি করেছিলেন’। নবাব ফয়জুন্নেসা সখী সমিতির সক্রিয় সদস্যরূপে তাদের প্রকাশিত পত্রিকারও নিয়মিত গ্রাহক ছিলেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে  সৌদি আরবে হজ পালনে গিয়েও ফয়জুন্নেসা মক্কা নগরীতে একটি মুসাফিরখানা ও মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন।

নবাব ফয়জুন্নেসা ১৯০৩ সালে ৬৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পূর্বে জমিদারির বড় অংশটি ওয়াকফ্ করে যান নওয়াব ফয়জুন্নেসা, যা থেকে কুমিল্লার লাকসামের দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীরা আজও বৃত্তি প্রদান করা হয়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, সমাজসেবা ও প্রশাসনিক দক্ষতার ক্ষেত্রে তিনি আধুনিক নারীদের উত্তম আদর্শ।

ছবির নির্দেশনা:

রচনাসূত্র:

১. https://www.bbc.com/bengali/news-59298002

২.https://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%9A%E0%A7%8C%E0%A6%A7%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%80,_%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%AC_%E0%A6%AB%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%9C%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B8%E0%A6%BE

৩.https://m.dailyinqilab.com/article/520236/%E0%A6%A8%E0%A6%93%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%AC-

%E0%A6%AB%E0%A7%9F%E0%A6%9C%E0%A7%81%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B8%E0%A6%BE-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%A8-%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF

৪.https://www.jaijaidinbd.com/feature/nondini/395907

৫.https://www.onnoekdiganta.com/article/detail/13299#google_vignette