শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু

Jun 26, 2024 - 23:31
 0  1

শ্রমজীবী আল্লাহর বন্ধু

মো: রায়হানুর রহমান, সহকারী শিক্ষক, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল ও কলেজ, বগুড়া

গতকাল (পহেলা মে ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ) সারা বিশ্বে পালিত হলো আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস (International Workers’ Day) যা মে দিবস (May Day) নামে পরিচিত)। দিবসটি ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে আমেরিকার শিকাগো শহরে ম্যাসাকার শহিদদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে পালিত হয়। সেদিন দৈনিক আটঘণ্টার কাজের দাবিতে শ্রমিকরা হে মার্কেটে জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক পুলিশ নিহত হয়।[1] শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ের এ আন্দোলনকে স্মরণ করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করা হয়। বাংলাদেশেএবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে-‘শ্রমিক মালিক গড়ব দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ।

ইসলামে শ্রমিকের মর্যাদা: শ্রমিকের মর্যাদা সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেন, আল কা-সিবু হাবীবুল্লাহ- শ্রমজীবী হচ্ছে আল্লাহর বন্ধু।(বায়হাকী)।[2] মহানবী (সা) আরো বলেন, নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্যের চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই। আল্লাহর নবী দাউদ () নিজের হাতে কাজ করে খেতেন।[3] নবী (সা) আরো বলেন, যাকারিয়া () ছুতোর (কাঠ-মিস্ত্রী) ছিলেন।[4] পবিত্র কোরআনে আদর্শ শ্রমিক হিসেবে হজরত মুসা (.)-এর বৈশিষ্ট্য এভাবে বর্ণিত হয়েছে, হে পিতা! আপনি তাকে শ্রমিক হিসেবে নিয়োগ দিন। নিশ্চয়ই আপনার শ্রমিক হিসেবে সে- উত্তম, যে সামর্থ্যবান বিশ্বস্ত।[5] শ্রমিকের সাথে সদ্ব্যবহার করা: মহান আল্লাহ বলেন, আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর কোন কিছুকে তার শরীক করো না; এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্থ, নিকট প্রতিবেশী, দুর-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির তোমাদের অধীনস্থ কর্মচারীদের প্রতি সদ্ব্যবহার করো নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না দাম্ভিক, অহংকারীকে।[6] নবী (সা) বলেছেন, তোমাদের কেউ যেন এরূপ না বলেআমার দাস, আমার দাসী। বরং বলবে-’আমার বালক’ ’আমার বালিকা’ ’আমার খাদিম[7]  দ্রুত পাওনা পরিশোধ করা: নবী (সা) শ্রমিকের পাওনা দ্রুত পরিশোধে জোর তাকীদ দিয়ে  বলেন, «أَعْطُوا الْأَجِيرَ أَجْرَهُ، قَبْلَ أَنْ يَجِفَّ عَرَقُهُ» তোমরা শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকিয়ে যাওয়ার পূর্বেই তার পাওনা পরিশোধ কর[8] নবী (সা) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন যে, কিয়ামতের দিবসে আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে বাদী হবো। তার মধ্যে এক ব্যক্তি হলো, যে কোন মজুর নিয়োগ করে তার থেকে পুরো কাজ আদায় করে কিন্তু তার পারিশ্রমিক দেয় না।[9] শ্রমিককে নির্যাতন না করা: হযরত আনাস (রা) বলেন, “আমি দশ বছর যাবৎ রাসুলুল্লাহ (সা)-এর খেদমত করেছি তিনি আমার সম্পর্কে কখনো উহ! শব্দ বলেননি এবং কখনো বলেননি, এটা করোনি কেন ? এটা করেছ কেন ? আমার বহুকাজ তিনি নিজ হাতে করে দিতেন[10]  শ্রমিককে ভরণ-পোষণ দেয়া: রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ তুমি নিজে যা খাও তা তোমার জন্য সদকা এবং যা তোমার ছেলেকে খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা, যা তোমার স্ত্রীকে খাওয়াও তাও তোমার জন্য সদকা। অনুরূপভাবে যা তোমার খাদেম (কর্মচারী)কে খাওয়াও সেটাও তোমার জন্য সদকা হিসাবে গণ্য হবে।[11] রাসুলুল্লাহ (সা) আরো বলেছেনঃ যখন তোমাদের কোন খাদেম খাবার রান্না করে তার  কাছে নিয়ে আসে। এমন খাবার যার তাপ ধোঁয়া সে সহ্য করেছে, তখন তার উচিত হবে তাকে কাছে বসিয়ে তা থেকে কিছু খাবার প্রদান করা। আর যদি খাবারের পরিমাণ অতি অল্প হয়, তবে সে যেন তার হাতে অন্তত এক-গ্রাস অথবা দুগ্রাস খাবার তুলে দেয়।[12] শ্রমিককে নিজের ভাই মনে করা: রাসূলুল্লাহ (সা) আবু যর (রা)কে খাদেমের ব্যাপারে বলেন, এরা তোমাদের ভাই, তোমাদের অনুগামী। আল্লাহ্ তা'আলা তাদেরকে তোমাদের কর্তৃত্বাধীন করেছেন। অতএব যার কোন ভাই তার কর্তৃত্বাধীন থাকে, তবে সে যা খায় তা থেকে যেন তাকে খাওয়ায়, যা পরিধান করে তা থেকে যেন তাকে পরিধান করায়। তাদের সাধ্যের অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব তাদেরকে দিবে না, যদি সাধ্যের অতিরিক্ত কোন দায়িত্ব দাও তবে তাদেরকে সাহায্য কর।[13] শ্রমিকের ত্রুটি-বিচ্যুতি ক্ষমা করা: আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা)এর নিকটে একজন লোক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল আমি খাদিমের অপরাধ কতবার ক্ষমা করব? তিনি (সা) বললেনঃ দৈনিক সত্তর বার[14] শ্রমিকের প্রতি মালিকের যেমন দায়িত্ব আছে, তেমনি মালিকের প্রতিও শ্রমিকের দায়িত্ব আছে। মালিকের প্রদত্ত দায়িত্ব নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও যথাযথভাবে পালন করা। এ সম্পর্কে নবী (সা) বলেছেন, যে খাদেম আপন প্রতিপালকের উত্তমরূপে ইবাদত করে এবং আপন মনিবের যে হক আছে তা আদায় করে, তার কল্যাণ কামনা করে আর তার আনুগত্য করে, সে দ্বিগুণ সাওয়াব লাভ করবে।[15] আয়েশা (রা) কর্তৃক বর্ণিত, নবী (সা) বলেছেন, অবশ্যই আল্লাহ পছন্দ করেন যে, তোমাদের কেউ কোন কাজ করলে সে যেন তা নৈপুণ্যের সাথে করে।[16] নবী (সা) বলেছেন, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই নিজ অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। যেমন- জনগণের শাসক তাদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। একজন পুরুষ তার পরিবার পরিজনদের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী স্বামীর ঘরের এবং তার সন্তানের দায়িত্বশীল, কাজেই সে তাদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। আর গোলাম আপন মনিবের সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। কাজেই সে বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। শোন! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। কাজেই প্রত্যেকেই আপন অধীনস্তদের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে।[17]

পরিশেষে মহান আল্লাহর নিকট সকল মেহনতী মানুষের কল্যাণ কামনা করছি।



[1] বিস্তারিত: উইকিপিডিয়া, Avrich The Haymarket Tragedy পৃষ্ঠা 208–209 

[2] আরো দেখুন: কানযুল উম্মাল, . ৪র্থ, পৃ. ১২৭

[3] সহিহ বুখারী:২০৭২।

[4] সহিহ মুসলিম:৬৩১২

[5] সুরা আল-কাসাস: আয়াত ২৬।

[6] সূরা আন-নিসা: আয়াত ৩৬।

[7] সহিহ বুখারি:২৩৮৪।

[8] সুনানে ইবনে মাজাহ:২৪৪৩।

[9] সহিহ বুখারি:২০৮৬।

[10] সহিহ বুখারি:৫৬১২

[11] মুসনাদে আহমাদঃ /১৩১।

[12] সহিহ বুখারি:২৩৮৮, সহিহ মুসলিম:৪১৭১।

[13] সহিহ বুখারী:২৩৭৭; সহিহ মুসলিম:১৬৬২]

[14] সুনানে তিরমিযি:১৯৪৯

[15] সহিহ বুখারি: ২৩৮৩, সহিহ মুসলিম: ৪১৭২।

[16] শুআবুল ঈমান বাইহাক্বী ৫৩১৩, ত্বাবারানীর আওসাত্ব ৮৯৭, সহীহুল জামে ১৮৮০।

[17] সহিহ বুখারি: ২৩৮৬।


Md. Raihanur Rahman Assistant Teacher of Armed police Battalion public school and College, Bogura