মহাজন ফকির
মহাজন ফকির
সুফিবাদে স্রষ্টা ও সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে আধ্যাত্মিক ধ্যান ও জ্ঞানের মাধ্যামে জানার প্রচেষ্টা করা হয়। আল-গাজ্জালি এর মতে, আল্লাহর ব্যতীত অপর মন্দ সবকিছু থেকে আত্মাকে পবিত্র করে সর্বদা আল্লাহর আরাধনায় নিমজ্জিত থাকা এবং সম্পূর্ণ রূপে আল্লাহুতে নিমগ্ন হওয়ার নামই সুফিবাদ বলে।
মহাজন সংস্কৃত শব্দ, যার আক্ষরিক অর্থ মহৎ মানুষ। তবে প্রায়োগিক অর্থে এর মানে বণিক, ডিলার বা দোকানদার, ব্যাঙ্কার, পোদ্দার এবং উপনিবেশিক ও প্রাক-উপনিবেশিক বাংলার প্রেক্ষাপটে কুসীদজীবী বোঝায়।
ফকির , ফকর ( আরবি: فقر) শব্দমূল থেকে এসেছে। এর অর্থ হল "দরিদ্র হওয়া বা দুঃখী হওয়া। এ হিসেবে ফকির শব্দের বাংলায় অর্থ হয় দরিদ্র, অভাবগ্রস্ত বা দুঃখী। বর্তমান বাংলা ভাষায় গরিব বা দরিদ্র বোঝাতেও ফকির শব্দ ব্যবহৃত হয়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
‘‘আমি জিন এবং মানুষকে একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি। আমি তাদের কাছে কোনো রিযিক চাই না কিংবা তারা আমাকে খাওয়াবে তাও চাই না। আল্লাহ নিজেই রিযিকদাতা এবং অত্যন্ত শক্তিধর ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা যারিয়াত: ৫৬-৫৮)।
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
‘‘হে লোক সকল! তোমরাই আল্লাহর মুখাপেক্ষী এবং আল্লাহ তো অভাবমুক্ত ও প্রশংসিত’’। (সূরা ফাতির: ১৫)
উপরের অংশে সূফীবাদ, মহাজন ও ফকির বিষয় নিয়ে অল্প কিছু আলোকপাত করা হয়েছে | এরপর মহান সৃষ্টিকর্তা তার সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য কি তাও তুলে ধরা হয়েছে | আমি মহাজন ও ফকির বিষয়টিকে সৃষ্টিকর্তার সাথে একীভূত করে মানুষের কৃত কর্মের কিছু বিষয় আলোকপাত করার চেষ্টা করছি |
আমরা পড়েছি মহান সৃষ্টিকর্তা যে কাজটি সবচেয়ে বেশি পছন্দ করেন তা হচ্ছে ক্ষমা করা | এমনটি বর্ণনায় শোনা গেছে যে, বান্দাগণ সৃষ্টিকর্তার নিকট তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাওয়ার যে সময় ব্যয় করেন , সৃষ্টিকর্তা তার চেয়ে অনেক কম সময়ে তার প্রিয় বান্দাদের ক্ষমা করেন |
অর্থাৎ বিষয়টা এমন মনে হয় যে, আমরা সৃষ্টিকর্তার নিকট ক্ষমা চাইতে কাল ক্ষেপণ করতে পারি কিন্তু তিনি, সৃষ্টিকর্তা আমাদের ক্ষমা করতে কালক্ষেপণ করেন না | তিনি বান্দাদের প্রতি তার রহমতের দৃষ্টি সর্বদাই সঠিক রাখেন |
আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল। মহান আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও মহাপ্রতাপশালী। তিনি ইচ্ছা করলে মুহূর্তের মধ্যে সকল অবাধ্য গুনাহগার বান্দাদের ধ্বংস করে দিতে পারেন। তার কাজে বাধা দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। এতদসত্বেও বহু সংখ্যক মানুষ তাকে এবং তার দেওয়া জীবন বিধানকে কেবল অস্বীকারই করে না, বরং তার বিরুদ্ধাচরণ করে এবং শিরকের ন্যায় জঘন্য পাপে লিপ্ত হয়। অথচ আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমা করে দেন |
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী দ্বারা বুঝা যায় যে, সবচেয়ে ভাল মানুষ ঐ ব্যক্তি যে অপরাধ করার পর আল্লাহর নিকটে ক্ষমা চায়। ক্ষমা প্রার্থনা করা সবচেয়ে বড় ইবাদত। এতে আল্লাহ যত বেশী খুশী হন, অন্য কোন ইবাদতে তিনি তত বেশী খুশী হন না। এজন্য নবী করীম (ছাঃ) দিনে প্রায় সত্তর বারেরও বেশী ক্ষমা প্রার্থনা করতেন।
আবু যার গিফারী (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন,... ‘হে আমার বান্দারা! তোমরা অপরাধ করে থাক রাত-দিন, আমি সমস্ত অপরাধ মাফ করে দেই। সুতরাং তোমরা আমার নিকট ক্ষমা চাও, আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিব’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৩২৬; বাংলা মিশকাত হা/২২১৮)।
জুনদুব (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহর কসম! আল্লাহ অমুককে মাফ করবেন না। তখন আল্লাহ বললেন, কে আছে যে আমাকে কসম দিতে পারে বা আমার নামে কসম খেতে পারে যে, আমি অমুককে ক্ষমা করব না। যাও আমি তাকে ক্ষমা করলাম এবং তোমার আমল নষ্ট করে দিলাম। তিনি অনুরূপ বলেছেন’ (মুসলিম, মিশকাত হা/২৩৩৪; বাংলা মিশকাত হা/২২২৬)।
এখানে মহাজন বলতে সৃষ্টিকর্তাকে বোঝানো হচ্ছে | অর্থাৎ তিনি এই পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন তার নিজের জন্য | দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান যা কিছু আছে সবই তার সৃষ্টি | এর সৃষ্টিতে তার কোন শরীক নেই | অর্থাৎ এসব কিছুর মালিক একজন তিনি |
আমরা সৃষ্টিকর্তার এই ভবের হাটে এসে সবকিছু ভুলে বিভিন্ন অন্যায় ও পাপাচার কাজে লিপ্ত হই | অনেক সময় এর জন্য আমরা মোটেও অনুতপ্ত হই না | এটাকে আমরা আমাদের অধিকার ভাবি | আমরা আমাদের দৈনন্দিন কাজের দ্বারা প্রতিনিয়ত অন্যদের কষ্ট দিচ্ছি, অন্যের ক্ষতি সাধন করছি, সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য থেকে নিজেদের বিচ্যুত করছি | আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের সৃষ্টিকর্তাকে |
কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সার্বক্ষণিক চেয়ে থাকেন, কখন তার সৃষ্টি তার নিকট তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করেন | অর্থাৎ তিনি ফকিরের মত তার বান্দাদের দিকে চেয়ে থাকেন, কখন তার প্রিয় বান্দারা তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে |