মগের মুল্লুক প্রেক্ষাপট এবং মব জাস্টিস

Oct 9, 2024 - 20:43
Oct 10, 2024 - 23:31
 0  38
মগের মুল্লুক  প্রেক্ষাপট এবং  মব জাস্টিস

গতি পরিক্রমা চক্র, ২৭ জানুয়ারি ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দ। বুধবার। দিনটি ইতিহাস স্বীকৃত এক তাৎপর্যময় অধ্যায়। সেই দিন মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খানের পুত্র-`বুজুর্গ উমেদ খান’ পরাস্ত করেন আরাকান ম্রাউক-উ রাজ্যের শক্তিশালী বাহিনীকে। পুনরুদ্ধার হয় নাফ নদী পর্যন্ত বাংলার সীমানা। ইতিহাসে এই ম্রাউক-উ  রাজ্যের শাসন আমল ছিল চরম অরাজকতায় ভরা। সীমাহীন দুঃশাসনের কারণে এ অঞ্চলটিকে মগের মুল্লুক বলা হত। এ রাজ্যের সীমানা ছিল ফেনী নদী থেকে সমগ্র আরাকান পর্যন্ত। মগের মুল্লুক বলতে বোঝানো হয় এমন এক দেশ যেখানে বিশৃঙ্খলা, প্রতিহিংসা, অন্যায়,অবিচার ও অনাচারে ষোলকলা পূর্ণ। আক্ষরিক অর্থে আরাকান রাজ্য তথা আজকের মিয়ানমার মগের মুল্লুক। 

স্বাধীন বঙ্গের সুলতানদের তাড়িয়ে শত বছর ব্যাপী মগ রাজত্ব চলছে চট্টগ্রামে। সময়ের ব্যবধানে তারপর একে একে মুঘল, ব্রিটিশ, পাকিস্তান এবং সবশেষে বাংলাদেশের জন্ম। প্রাচীনকালে বাণিজ্যিক কারণে হাজার বছরের উজ্জ্বল ইতিহাস আছে চট্টগ্রামের। আরাকানে এ রাজ্যটিতে ম্রাউক-উ শাসনকালে নজিরবিহীন অরাজকতা চলেছে। মানবিক আচরণ-বিধি না থাকায় মানুষও কেনা-বেচা হয়েছে দাস হিসেবে। মহাকবি আলাওয়ালও শৈশবে দাস হিসেবে বিক্রি হন এবং নিজ মেধা বলে আরাকান রাজসভায় স্থান করে নেন। ১৬২৫ সনের বাংলা ছিল উন্নয়নের উজ্জ্বল অহংকার। ঠিক এ সময় পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুরা পূর্ব-নিম্নবঙ্গে লুটপাট শুরু করে। সে সময়ের বঙ্গের শাসক মুঘলরা ছিলেন আফগান ভূমির অধিবাসী। সমুদ্রপথে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা না থাকায়  চূড়ান্ত মাশুল দিতে হয়েছিল তাদের। দুর্বৃত্তদের অপবিত্র হাত স্পর্শ করেছিল বাংলার আঁচল।

মগ দস্যু নৌপথ যুদ্ধে পারদর্শী হওয়ার মুঘলরা তাদের প্রতিরোধে ব্যর্থ হন। তার মধ্যে তৎকালীন সুবাদার খান-ই দুরান ছিলেন একজন দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। জলদস্যুদের আক্রমণ ভয়ে তিনি ঢাকা ছেড়ে পলায়ন করলে, মগেরা এ অঞ্চলে তাদের রাম রাজত্ব শুরু করে। সেদিন আমাদের এই বঙ্গ লুটপাটে মগ ডাকাতের একান্ত দোসর হয়েছিল পর্তুগিজ, ওলন্দাজ তথা ডাচ-ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। সমগ্র আরাকানে মগদের অত্যাচার অব্যাহত ছিল প্রায় দুশো বছর জুড়ে। সময়ের প্রবাহে এ অরাজকতা ব্রিটিশরা যেমন বজায় রেখেছিল,তেমনি সে পথেই চব্বিশ বছর পার করেছে পাকিস্তানিরা। ১৯৭১-সালে বাংলাদেশের জন্ম হলে সুবিধাবাদী শ্রেণি সরকারের খুব কাছে থেকে এই অরাজকতায় নতুন রঙ লাগায়। সাম্প্রতিক সময়ে আইনের বাইরে গিয়ে অন্যের উপর প্রভাব,অবিচার এবং  অসহায় মানুষের আহাজারি, জাগ্রত জনতাকে ‘মগদে’র স্মরণ করে তার সঙ্গে অভিন্নতা খুঁজে দেখবার সুযোগ করে দিয়েছে।

কোনো দেশে অন্যায়-অত্যাচার বেড়ে মানুষের টিকে থাকা তথা জীবনধারণ দুর্বিষহ হয়ে পড়লে সেখানে ন্যায় বিচারের প্রশ্ন দেখা দেয়। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ‘জাস্টিস’ কথাটি তাই খুব কাঙ্ক্ষিত বিষয় হয়ে ওঠে তখন। সময়ের প্রেক্ষিতে সমস্বরে স্লোগান ওঠে-‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস।’ এই জাস্টিসের বিপরীতে আছে-‘মব জাস্টিস’-তথা উত্তাল জনতার হাতে বিচার করার অনিবার্য মাদকতা। সম্প্রতি আইনের বাইরে জনতার বিচারের নামে এক ধরনের উন্মাদনা থেমে থেমে চলছে। বিষয়টি সামগ্রিক কোনো কারণ কিংবা প্রেক্ষাপটে হচ্ছে, তা বলা যায় না। তবে গভীর বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়,সভ্যতার বিকাশপথে মানুষের সামাজিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত, ব্যক্তি মত প্রকাশের মুক্ত পরিবেশ, বৈষম্যহীন জীবন-যাপনের সুযোগ এবং ধর্মচর্চার সুবিধাসহ মৌলিক জীবন কাঠামোর সুবিধা প্রাপ্তির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রাত্যহিক-জীবনে নাগরিকের এসব কাঙ্ক্ষিত বিষয়ের প্রাপ্তি না ঘটলে সমাজ-রাষ্ট্রে বিচারহীনতার সংস্কৃতি জন্ম নেয়। কেননা মানুষ জানে, রাষ্ট্রের মধ্যে তার রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার চর্চা জন্মগত অধিকার। 

কিন্তু দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন,অবিচার ও শোষণ অভ্যস্ত এ ভূ-খণ্ডের মানুষের মধ্যে সেই অধিকার চর্চার পথ কখনো মসৃণ পথে এগোতে পারেনি। একইসঙ্গে তাদের জীবনে পর্যায়ক্রমে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আবেগীয় ধর্মীয় প্রভাব জীবনকে অতিমাত্রায় প্রভাবান্বিত করেছে। ফলে আনুক্রমিক ভাবে এ পথ বেয়ে কিছু নেতিবাচক বিষয় তথা ‘বিচারহীনতা,শোষণ,দমন,দুর্নীতি,সন্ত্রাস,মিথ্যাচার,দলদাসত্ব,গোষ্ঠীপ্রীতি ও শ্রেণি-স্বার্থপরতা’ মানুষকে নাগরিক দায়বোধে উজ্জীবিত হতে অবকাশ দেয়নি কখনো। এমনকি তাদের অনেকের মধ্যে অকৃত্রিম দেশপ্রেম বোধও জন্ম নেয়নি। ফলে এক ধরনের-‘অস্থির ও অপ্রকৃতিগ্রস্ত জীবনাচারণে অভ্যস্ত নাগরিক সমাজ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও নিজস্ব স্বাধীনতা সত্তা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি’ ও জাতীয়তাবোধে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। যা জাতির জন্য খুব হতাশা ব্যঞ্জক এবং অপ্রত্যাশিত বেদনার। 

স্পর্শকাতর এমনি নাজুক মুহূর্তগুলোতে জাতীয় চরিত্রে ভর করে পল্টি খাওয়া সুবিধাবাদী চক্র। বলার অপেক্ষা রাখে না, ‘এই দুষ্টচক্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ইন্ধনে সমাজ-রাষ্ট্রে যে ধরনের অস্থিরতা বিরাজমান, তার বহিঃপ্রকাশ-‘মব জাস্টিস’ বা আইন বহির্ভূত জনতার বিচার।’ কিন্তু মানুষের এই প্রবণতা মানুষকে হিংস্রতার সারিতে নিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। অথচ বোধসম্পন্ন মানুষ মাত্রই জানে ‘একটি রাষ্ট্রের সংবিধান, স্বাধীনতা এবং বিচারব্যবস্থার জন্য ‘মব জাস্টিস’ যেমন অবমাননাকর তেমনি ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত বটে।’ 

মানব চরিত্র বড় জটিল ও দুর্বোধ্য। প্রাচীন যুগ থেকে নিজস্ব মতবাদ ও শ্রেষ্ঠত্বের দ্বন্দ্বে সে জড়িয়েছে সব সময়। মানুষের এই দ্বন্দ্ব তথা সংকট উত্তরণের তাগিদেই রাষ্ট্রতত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সমাজবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রিক সংস্কৃতিতে এসেও তার তেমন পরিবর্তন হয়নি বললেই চলে। কেননা মানুষ সামাজিক ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা ভোগ তথা সুবিধার অসমতার জন্য এবার নিজেদের মধ্যে কলহ সৃষ্টিতে তৎপর হয়েছে। রাষ্ট্র ধারণা প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই রাষ্ট্রীয় নিয়মের প্রয়োগ ও তা মান্যতার মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। 

কিন্তু এই নিয়ম প্রয়োগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণে যখন ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, ঠিক তখনি রাষ্ট্রের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ে। ফলে এই অবস্থায়  রাষ্ট্রকে উদার গণতন্ত্র ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেবার অপরিহার্যতা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। দার্শনিক মিশেল ফুকো বিষয়টির উপর অভিমত দিতে গিয়ে বলেছেন- ‘এটি সমাজের একটি স্বাভাবিকীকরণ হতে পারে, যেখানে বিচ্যুতিকে শাস্তি দেওয়া হয় এবং সামঞ্জস্যকে পুরস্কৃত করা হয়।’ আর তখনি রাষ্ট্রের সকল নাগরিক চলার পথে আইন মেনে চলতে প্রেরণা পায় এবং শৃঙ্খলা প্রতিপালনে তৎপর হবার তাগিদ অনুভব করে। (ক্রমশ)