বিয়োগ কপোত কষ্ট

Jul 18, 2024 - 18:50
Jul 18, 2024 - 17:40
 0  22
বিয়োগ কপোত কষ্ট
ইন্টারনেট

     নওগাঁর একটি প্রান্তিক গ্রাম, কাঁচা প্রশস্ত রাস্তা। দুপাশে ছড়ানো মাঠে ধান,গম,কালাই,সরিষা প্রভৃতি শস্যের নরম মায়া।রাস্তা ধরে ইউক্যালিপটাস আর সুন্দরী বৃক্ষের ঘন সবুজ নিবিড়তা।শুদ্ধ বাতাস আর গোরু-মহিষের বোঝাই গাড়ির ক্যাচ ক্যাচ শব্দযন্ত্রে কণ্ঠ মেলানো গাড়োয়ানের বেসুরো গানে কমে পথিকের গতি।পথের প্রান্ত ঘেঁষে একটি অভিজাত চুনরঙা মাটির দোতলা। সীমান্ত জুড়ে আলকাতরার প্রলেপ।রুপোলি টিনের দ্যুতিময় অহংকারী বাড়িটিকে দূর থেকে চেনা যায়।সাথে মুক্ত উঠোন–গাদা,জবার রুপ আর কবুতরের উড়ন্ত পাখার কসরতী বাকবাকুমে মুঠো মুঠো সুখ ছড়ানো।দক্ষিণে তালগাছবেষ্টিত টলটলে সিঁড়িকাটা পুকুর। যেখানে তপ্ত দুপুরে মাছ আর মানুষের জলকেলি।সে বাড়ির শিক্ষিত,রুচিস্নিগ্ধ,শ্যামবর্ণের পৌরুষদীপ্ত এক তরুণ!উদাস দুপুরের নীরবতা ভাঙে সুশ্রীদীর্ঘা ফর্সা ত্রয়োদশীর শুভদৃষ্টিতে। মুহূর্তেই তরুণের হৃদস্পন্দন থেমে যায়।মনের চিত্রপটে এতকাল আনাড়ি হাতে যে অবয়ব গড়েছে,আজ যেন সে মূর্ত শরীরী মানসী!রঙিন চেকশাড়ি পড়া চপলার ভালোবাসা আর যত্নে বাড়িটি হয় আরো মোহনীয়।

গোধূলি বেলায় শ্বাশুড়ির চোখের আড়ালে নববধূ স্বামীর সাথে পুকুরজলে পা ডুবিয়ে বসে প্রেমাবেগ ঘনিষ্ঠতায়।জলের ভিতর দেখে চাঁদের লুকোচুরি।চায় তালগাছের দীঘল ছায়ার মত অনন্ত জীবন। এভাবে কাটে অজস্র মুহূর্ত,যার কোন মানে নেই। আছে শুধু অপার অনুভব।

উত্তরসূরীর দাবিতে ঘর আরো সুখময় করে পিঠাপিঠি তিন চাঁদমুখ।বড় পুত্রের বয়স প্রায় চার, ত্রয়োদশী ক্রমশ পূর্ণা ষোড়শী আর তরুণ মেজাজী অপ্রতিরোধ্য!চারপাশে ভয়ঙ্কর যুদ্ধাবস্থা! মৃতের পাহাড় বেয়ে পাকিস্তানিরা ছোটে মানচিত্র চিবিয়ে খেতে!পুরো দেশ যখন কবর আর কাফন গুনে গুনে ক্লান্ত,ঠিক এসময়ও লাজবতী গ্রামটি মিলিটারির শকুন চোখের আড়ালে!দেশমাতার অধিকার কোন পরদেশির হতে পারে না! শুরু হয় প্রতিরোধ। গৃহলক্ষ্মীর ভালোবাসা আর নিষ্পাপ মায়া ছিঁড়ে আটপৌরে জীবনবিলাসী তরুণ যুদ্ধে সক্রিয় অংশ না নিয়েও নীরব সমর্থন করে। পাশে থাকে অন্য অন্য যোদ্ধার। তার বুকেও যে স্বপ্নের বাংলাদেশ!

একদিন বিকেলে প্রতিবেশীর ডাকে চমক ভাঙা ঘোরে ঘরের বাইরে বের হয়।সরুপথ ধরে রাস্তার বাঁকে,যেখানে তার প্রিয় মনভূমি, সুখের বর্গক্ষেত্র একটুকরো বুকজমিন!অবাধ সবুজে উঁচানো রাইফেল হাতে উর্দিপরা দুজন মিলিটারি!আতঙ্কী কণ্ঠে বলে 'তুম মুক্তি হ্যায়'? তরুণের নির্ভয় উত্তর 'নেহি'।ভয়হীন চোখে দৃষ্টি ফেলে মিলিটারির হয়তো বিশ্বাস জাগে।বলে,'ইয়ে কসুরওয়ার নেহি হ্যায়।'। মুহূর্তেই প্রতিবেশীরুপী মুখোশে রাজাকার কুত্তার লোভনীয় অফার,'তুমলোগোকে খাস্সি খিলাউঙ্গা,‘মার দো,মার দো’।ট্রিগার থেকে পরপর দুটো বুলেট–অবশিষ্ট বিকেলের মৌনতা ভাঙে।

ঘাসগালিচায় রক্তের মানচিত্রে পড়ে থাকে নিথর দেহ,ষোড়শীর অহংকার আর শিশুমনের অভয়ারণ্য প্রিয় বাবা! আতঙ্ক আর ত্রাসে ভারি হয় সন্ধ্যার আকাশ।শান্তি মোছে দিকভ্রান্ত কপোত।শরীরের রঙ ঢাকে সাদা থানে সদ্য বিধবা!..এবং তাকে ঘিরে তিনটি নীলপদ্ম.. বেদনার নীলে মিশে।

তখন সঙ্গীহীন শ্বেতশুভ্রা কপোতী চঞ্চুতে তুলে রাখে বিয়োগ কপোত কষ্ট...