বঙ্গবন্ধু ও একজন দালাইলামা

Jul 4, 2024 - 20:38
Jul 5, 2024 - 01:33
 0  40
বঙ্গবন্ধু ও একজন দালাইলামা

উজ্জ্বল ঐতিহ্য নিয়ে হাজার বছর ধরে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। যুগের প্রবাহে অজস্র পালাবদল ঘটেছে তার। অষ্টম শতকের বৌদ্ধ পাল শাসকদের মায়া জড়ানো ৪০০ বছরের বাংলা। কিন্তু কপালে সুখ নাই সবুজ-শ্যামল বাংলার। কর্নাটক থেকে এলো দুর্ধর্ষ সেন বাহিনী। নির্মমতার সীমা ছাড়িয়ে তারা এ দেশের মানুষের জীবনকে ঢেকে দিল অন্ধকারে। দখলদারি এ শাসকেরা ব্যর্থ হল সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে। জনবিক্ষোভের বিস্ফোরণে ১৫০ বছরের মধ্যে পতন হল তাদের। ১৩ শতকে কর্তৃত্ব বদল হলো তুর্কিদের হাতে । 

শুরু হলো সুলতানি ও মোগল শাসন। তাদের শাসনকালের সীমা ছিলো ৬০০ শত বছর। বলতে দ্বিধা নেই ‘মুসলিম শাসনামলে বাংলার সমৃদ্ধির গৌরবময়কাল।’১ এ সময়ে প্রত্যাবর্তন ঘটে বৌদ্ধ যুগের অসাম্প্রদায়িক আবহের। কিন্তু পথ রুদ্ধ হয় ১৮ শতকে পলাশী প্রান্তরে। ইংরেজদের ২০০ বছর ভালো-মন্দের পালাটানে কালাতিপাত করতে থাকে বাঙালি। ঘটনার নানা স্তর পেরিয়ে ভারত ভূমি ১৯৪৭ সালে মুক্তি পায় ব্রিটিশ কবল থেকে। ভারত ও পাকিস্তান নামে মানচিত্র পৃথক হলেও বাঙালি এবার প্রবেশ করে পাকিস্তানি জাতির দুঃশাসনে। তাদের বৈষম্য-নীতি মাত্রা ছেড়ে গেলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে বাঙালি জাতি। 

পাকিস্তান বিরোধী উত্তাল রাজনীতির পাঞ্জারি হিসেবে এক পর্যায়ে রাজনীতির মঞ্চে দৃঢ়ভাবে হাল ধরেন শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর শক্তিশালী নেতৃত্বে বাংলার রাজনীতি সামনে পাড়ি দিতে থাকে বন্ধুর পথ। মানুষের আস্থা ও ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। তারপর দীর্ঘ পথ পেরিয়ে বিশাল হৃদয়ের এই মানুষটির নির্দেশে মুক্তির জন্য শুরু হয় যুদ্ধ ১৯৭১ সালে। সংগ্রাম চলে দীর্ঘ নয় মাস। জন্ম হয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। মানব মুক্তির মহান নেতা হয়ে ওঠেন শেখ মুজিব। কিন্তু দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের হিংস্র থাবা বিবর্ণ করে দেয় বাঙালির স্বপ্নকে। ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট ৩২ নম্বর বাড়িতে রাতের অন্ধকারে তাাঁকে নির্মমভাবে স্বপরিবারে জীবন দিতে হয়। দেহের মৃত্যু হয় মুজিবের কিন্তু বাঙালির প্রাণের গহীনে তিনি জায়গা করে নেন জাতির পিতা হিসেবে।  

মানুষের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ভালোবাসা, ত্যাগ ও লড়াই  বড় গৌরবের বিষয়। এমন অকৃত্রিম দেশপ্রেম, মহান দেশপ্রেমিক না হলে উপহার দেওয়া সম্ভব নয় কারো পক্ষে।  বিশ্বের রাজনীতিবিদদের দিকে নজর দিলে বঙ্গবন্ধু মত আর একজনের ভেতর দেশপ্রেম ও মানব প্রেমের অবিনাশী চেতনার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। তিনি হলেন তিব্বতি নেতা দালাইলামা। দালাইলামার বর্তমান বয়স ৮৮ বছর। প্রকৃত নাম তেনজিন গায়েসো। তিনি তিব্বতের ১৪তম দালাই লামা। মানবিক এই মানুষটিকে নিয়ে পাকিস্তানিদের মতো জটিল খেলা শুরু করেছে শক্তিধর রাষ্ট্র চীন। অশীতিপর মানুষটি যখন বয়সজনিত ও শারীরিক কারণে শয্যাশায়ী। পৃথিবীর নানা প্রান্তের তিব্বতিরা দালাইলামার স্থলাভিষিক্ত পরবর্তী ব্যক্তির চিন্তায় অস্থির এবং একইসঙ্গে তাঁর দীর্ঘায়ু কামনায় ব্যাকুল চিত্ত।

ঠিক সে মুহূর্তে চীন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তাঁর মৃত্যুর জন্য। কারণ দালাইলামা তিব্বতবাসীর স্বাধীনতার জন্য অবিরত লড়াই করে যাচ্ছেন চেতনা ও কর্মে। তিব্বতবাসীর মুক্তির লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর মতই তিনি তাঁর প্রতিজ্ঞায় ইস্পাতসম স্থির। বিপ্লবী মানুষটির জায়গায় চীনের তাই কৌশলগত কারণে প্রয়োজন এক আজ্ঞাবহ পুতুল উত্তরাধিকারী। বাঙালি জাতি যেমন বঙ্গবন্ধুকে তাদের দিশারী বলে জানে। তেমনি তিব্বতি জাতি দালাইলমাকে জীবন্ত অবতার বলে মনে করে। ১৩৯১ সাল থেকে দালাইলামা ১৩ বার পুনর্জন্ম লাভ করেছেন।

সে দেশের রীতি অনুসারে একজন দালাইলামা মারা গেলে পরবর্তী দালাইলামা অনুসন্ধান শুরু হয়। এক্ষেত্রে প্রয়াত গুরুর প্রধান শিষ্যরা শাস্ত্রীয় লক্ষণ ও দর্শনের ভিত্তিতে পরবর্তী দালাইলামা নির্ধারণ করেন। অবাক হলেও সত্য সাম্প্রতিক সময়ে চীন সরকার ঘোষণা দিচ্ছে পরবর্তী দালাইলামা শনাক্ত করার অধিকার শুধু তাদেরই আছে। অবশ্য চীন যে এই প্রথম তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের নেতা নির্ধারণ করতে চাইছে তা কিন্তু নয়। তিব্বতি জাতির দিকে তাকালে দেখা যায় এক করুণ নির্মমতা। আধ্যাত্মিক গুরুত্বের দিক দিয়ে দালাইলামার পর অবস্থান থাকে ‘পঞ্চেন লামা’। এটি একটি পদবী দালাইলামার মত। ৬ বছর বয়সী এক বালককে এ পদে সত্যায়ন করেছেন গুরু দালাই লামা। কিন্তু ১৯৯৫ সালে পঞ্চেন লামাকে অপহরণ করে চীন সরকার। এতেই শেষ নয় চীন সরকার নগ্নভাবে নিজেদের পছন্দমত একজনকে ‘পঞ্চেন লামা’ হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। 

তিব্বতবাসীর মুক্তির বাসনাকে স্তব্ধ করতে দালাইলামার পঞ্চেন লামাকে ৩০ বছর ধরে চীনের কারাগারে বন্দি করে রেখেছে সরকার। বিস্মিত ও শিহরিত খবর হলো পঞ্চেন লামা বর্তমান বিশ্বে সবথেকে বেশি দিন কারাগারে থাকা বন্দী রাজনীতিবিদ। চীন নাটক দৃশ্যায়ন এখানেই শেষ করেনি বরং বিশ্বনেতা হবার বাসনায়  নাট্যমঞ্চে উপহার দিয়ে চলেছে একের পর এক কুশীলব। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের তৃতীয় সর্বোচ্চ নেতার পদবী কর্মপা। ইনি কর্ম কাগ্যু সম্প্রদায়ের প্রধান আধ্যাত্মিক নেতা। এই নেতা নির্বাচনেও চীন সরকার হস্তক্ষেপ করেছে ১৯৯৯ সালে কর্মপা ‘ওগিয়েল ত্রিনলে দোরজে’ সরকারের নির্দেশে ভারতে প্রবেশ করে।  চীন মূলত তাকে তাদের চর হিসেবে ভারতে পাঠায়।  ভারত সরকার  তাকে ধরার পর ২০১৮ সালে সিদ্ধান্ত নেয়, চীনের মনোনীত এ কর্মপাকে তাঁর সম্প্রদায়ের বৈধ প্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দিবে না। 

একটি  পদকে মর্যাদা ও অহমিকার প্রতীক বলে মনে করে সভ্যসমাজ। এ কারণে দালাইলমা পদটি  চীনের কাছে অনেক বড় মূল্যবান জিনিস। ‘বর্তমান দালাইলমার জন্ম ১৯৩৫ সালে। ১৯৩৭ সালে মাত্র দুই বছর বয়েসে ১৪তম দালাইলামা হিসেবে শনাক্তকরণ হয়েছিল।’২ যথাযথ নিয়ম মেনে ১৩তম  দালাইলামা তাঁকে মনোনীত করেছিলেন। ১৯৫১ সালে চীন তিব্বত দখল করলে দালাইলামা চীন সরকারের পথের কাঁটা হয়ে যান। ১৯৮৯ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী দালাইলামা অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতীয় প্রতিরোধকে স্পষ্ট করেন। ২০১১ সালে তিনি প্রবাসী তিব্বতি সরকারের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেন। একজন দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হিসেবে দালাইলামা যেন বঙ্গবন্ধুর চেতনার প্রতিরূপ। বাঙালির স্বাধীনতার পূর্বে ভয়াবহ উত্তাল দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধু যেমন সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিয়ে জাতিকে আশার আলো দেখিয়েছেন। ঠিক তেমনি দালাইলামাও যেন বঙ্গবন্ধুর অসামান্য বিচক্ষণতাকে ধারণ করে স্পর্শকাতর মুহূর্তে একটি চরম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

দালাইলামা ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে-‘তিনি পুনর্জন্ম না নেওয়ার সিদ্ধান্তও নিতে পারেন। অর্থাৎ তিনি যদি ঘোষণা দেন তিনি মানবজীবন নিয়ে পুনর্জন্ম নেবেন না, তাহলে তার অর্থ হবে তিনিই শেষ দালাইলামা। ফলে তাঁর পরে আর কোনো দালাইলামা আসবেন না। তাহলে এটি হবে তার এমন এক সিদ্ধান্ত যা চীনের ঠিক করা যেকোনো দালাইলামার বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতাকে করবে’৩ প্রশ্নবিদ্ধ এবং গুরুত্বহীন। মা, মাটি আর মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা থাকলে নিজের জীবনকে বিপন্ন করতে দুঃসাহস দেখানো যায়। যেমনটি দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরাধীন বাঙালিকে স্বাধীনতা পাইয়ে দিতে সারাজীবন লড়েছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। এনে দিয়েছেন কাঙিক্ষত স্বাধীনতা জাতির কপালে। একুশ শতকের এই প্রান্তে একজন দালাইলামাও বঙ্গবন্ধুর আদর্শকেই ভিতরে লালন করে জাতিকে মুক্তির দিশা দিতে চান। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুর মতো দালাইলামা একটি জাগ্রত নাম হিসেবে তিব্বতবাসী তথা মুক্তিকামী মানুষের কাছে স্মরণের তালিকায় স্থান পাবেন। 

তথ্যসূত্র : 

১. এ কে এম শাহনেওয়াজ - জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় 

২. প্রাগুপ্ত ঐ 

৩. ব্রহ্ম চেলানি-পরবর্তী দালাইলামা নির্ধারণ-প্রোজেক্ট সিনডিকেট