টুরকানা বয় : দুই পায়ে হাঁটা প্রথম মানুষের ফসিল প্রতিনিধি

বিজ্ঞান বলে মহাজগতের সকল জীবই একটিমাত্র অনুজীব থেকে ক্রমান্বয়ে বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের অগণিত জীবে পরিণত হয়েছে। এই অনুজীবের উৎপত্তি ঘটেছিল পানিতে। পানিতে উৎপন্ন অনুজীবটি কোটি কোটি বছর পরে দুইটি জীবকুলে প্রবাহিত হয় যাদের একটি হল, প্রাণি, অন্যটি উদ্ভিদ। পানির প্রাণি ক্রমান্বয়ে ভূমিতে বিচরণ শুরু করে। এরপর এক সময় তাদের একটি শাখা আকাশেও উড়তে শুরু করে। ভূমির প্রাণিদের একটি শ্রেণি বানরসদৃশ প্রজাতিতে বিবর্তিত হয়। যাদের নাম দেয়া হয় প্রাইমেট। এই প্রাইমেটদেরই একটি শাখা ক্রমান্বয়ে দুই পায়ে হাঁটতে শুরু করে যাদের নাম দেয়া হয়েছে হোমো বা মানুষ। এই হোমোদের একটি শ্রেণি এক সময় আজকের আধুনিক মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্সে বিবর্তিত হয়েছে।
আজ যেমন গরু, মহিষ, বাঘ, সিংহ ইত্যাদি প্রাণি একই গণভূক্ত হওয়ার পরও বিভিন্ন প্রজাতি বা ফ্যামিলি রয়েছে তেমনি মাত্র দশ হাজার থেকে বিশ লাখ বছর পূর্বেও পৃথিবীতে মানবকুলেরও বিভিন্ন প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল। দশ হাজার বছর পূর্বেও পৃথিবীর বুকে আজকের হোমো সেপিয়েন্স ছাড়াও অন্তত ছয়টি প্রজাতির মানুষ বিচরণ করত। এ প্রজাতিগুলোর একটি ছিল হোমো ইরেক্টাস বা হোমো আর্গাস। আজ আমরা হোমো ইরেক্টাসদের একজন প্রতিনিধির আবিষ্কৃত একটি বালকের কঙ্কাল ফসিল নিয়ে আলোচনা করব।
ঊনিশ শত চুরাশি সাল। রিচার্ড লিকির নেতৃত্বে ফসিল তত্ত্ববিদদের একটি দল কেনিয়ার টুরকানা হ্রদের তীরবর্তী এলাকায় ফসিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন। এক পর্যায়ে তারা নারিওকোটোম এলাকায় শুকনো নদীর বুকে একটি মাথার খুলি দেখতে পান। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খননকার্য চালিয়ে একটি মানব কঙ্কালের হাড়গোড় খুঁজে পান। একটি মানুষের কঙ্কালে যতগুলো হাড় থাকে একটি বাহুর হাড় ও হাত ও পায়ের পাতার সামান্য অংশ ছাড়া তার সবগুলোই পাওয়া যায়। প্রত্নতত্ত্ববিদদের ভাষায় এ ফিসিলটির কোড নাম দেয়া হয়, কেএনএম-ডাব্লিউটি-১৫০০০। কিন্তু সাধারণভাবে একে বলা হয় ‘টুরকানা বয়’ নামে।
ফসিলের হাড় ও দাঁতের পরিপক্কতা বিবেচনা করে বিজ্ঞনীরা মনে করছেন, এটি একটি বালকের কঙ্কাল। মৃত্যুকালে যার বয়স হয়েছিল আট থেকে ১২ বছরের মধ্যে। উচ্চতা ছিল পাঁচ ফিট তিন ইঞ্চি। তবে সম্পূর্ণ বয়স্ক হলে উচ্চতা বেড়ে দাঁড়াত ছয় ফিট পর্যন্ত । বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন তার ওজন হত ৬৮ কেজির মতো।
টুরকানা বালকের পূর্ববর্তী প্রজাতি যেমন, অস্ট্রালোপিথেকাসদের চেয়ে এর কোমর ছিল চিকন ও উরুর হাড় ছিল লম্বা যা আজকের মানুষদের মধ্যে দেখা যায়। টুরকানা বালকের মস্তিষ্কের আকার আজকের মানুষ, তথা হোমো স্যাপিয়েন্সদের চেয়ে ছোট ছিল। কিন্তু তাদের পূর্বের প্রজাতি হোমো হাবিলিসদের চেয়ে কিছুটা বড়। টুরকানা বালকের শরীরের তুলনায় তার মগজের আকার ও পরিমাণ তার পূর্ববর্তী প্রজাতিগুলোর মগজের চেয়ে বড়।
টুরকানা বালকের ফসিল কঙ্কাল গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা আজকের মানুষের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছেন।আজকের মানুষের অভিন্ন পূর্ব পুরুষ প্রাইমেটদের মস্তিষ্কের ওজন থেকে তাদের পরবর্তী পুরুষদের মস্তিষ্কের ওজন ক্রমান্বয়ে বাড়তে শুরু করে। আধুনিক মানুষের মগজ পনের থেকে ঊনিশ লাখ বছর আগে বাড়তে বাড়তে মোটামুটি গ্রহণযোগ্য আকারে উন্নত হওয়া শুরু করে। ক্রমান্বয়ে তা আজকের মানুষর গড় মগজের আকারে এসে উপনিত হয়। বর্তমানের মানুষের মগজের পরিমাণ তার শরীরের ওজনের ২%। পুরুষের ক্ষেত্রে মগজের আয়তন ১২৬০ সিসি ও নারীর ক্ষেত্রে ১১২০ সিসি।
টুরকানা বয়ের আবিষ্কার থেকে বিজ্ঞানীরা জানতে পেরেছেনে যে হোমো গণের জীবগুলোর মধ্যে প্রথম দুই পায়ে হাঁটা শুরু করা মানুষদের উৎপত্তি হয়েছিল প্রায় বিয়াল্লিশ লাখ বছর আগে। টুরকানা বালক এ অঞ্চলের প্রথম আবিষ্কার নয়। ১৯৭২ সালে বার্নাড জেনিও ও মিভ লিকি ঊনিশ লাখ বছরের পুরনো হোমো হ্যাবিলিসের ফসিল আবিষ্কার করেছিলেন। প্রথম আবিষ্কারের প্রায় একযুগ পর লিকির টিম যে আবিষ্কারটি করেন তা পনের লাখ বছরের পুরনো একটি হোমো ইরেকটাসের ফসিল। তবে এটি টুরকানা বালক নামেই বেশি পরিচিত।
বিজ্ঞানীরা ফসিল পরীক্ষা করে জানতে পেরেছেন যে, টুরকানা বালক তার প্রাপ্ত জীবনে উপণিত হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেছিল। তার মৃত্যুর কারণ ছিল দাঁতের গোড়ায় সংক্রমণ। তার দুইটি দুধের দাতেঁর গোড়ায় সংক্রমণ দেখা দিয়েছিল যা ক্রমান্বয়ে তারা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে রক্ত দূষিত করে। এ রোগটিকে বলা হয় সেপটিসেমিয়া। মৃত্যুর পর এ বালকের শরীর আগ্নেয়গিরির লাভার ছাইয়ের আস্তরণে ঢাকা পড়ে। প্রথম অগ্নুৎপাতের প্রায় পাঁচ লাখ বছর পর আরও একটি অগ্নুৎপাতের লাভা তার শরীরের উপর পড়ে। এভাবে লাভার ভিতর আটকা পড়ে থাকে প্রায় পনের লাখ বছর। বায়ু প্রবাহ, ঝড়-বৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক কারণে শরীরের উপরের লাভা ক্ষয়ে ক্ষয়ে তার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়ে। এজন্য বিজ্ঞানীরা তার ফসিল আবিষ্কার করতে সমর্থ্য হয়।
টুরকানা বালকের ধ্বংসাবশেষ আমাদের মানব জাতির বিবর্তন সম্পর্কে অতি মূল্যবান তথ্য দিয়ে সহায়তা করছে। আজ পৃথিবীর মানুষ জানতে পেরেছে তাদের জীব বিবর্তনের ধারায় টুকানা বয় ( হোমো ইরেকটাস) এর প্রজাতিই ছিল দুই পায়ের উপর সাবলিলভাবে ভর দিয়ে চলা প্রথম প্রাণি। তাই এ ফসিল কঙ্কালটি পৃথিবীর নৃবিজ্ঞানের গবেষণা তথা মানুষের উৎপত্তির ইতিহাস রচনার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান আলামত। তাই এটির বৈজ্ঞানিক মূল্য অত্যন্ত বেশি। এজন্য এটি চুরি যাওয়ার ভয় রয়েছে। তাই কেনিয়া সরকার টুরকানা বয়ের মূল কঙ্কালগুলো একটি শক্তিশালী নিরাপত্তাবিশিষ্ট কক্ষে আবদ্ধ করে রেখেছে। স্বনামধন্য গবেষক ও রাষ্ট্রীয় অতিথিগণ ছাড়া কেনিয়ার যাদুঘরের এই অংশে কাউকে প্রবেশের অনুমতি দেয়া হয় না।
রচনাসূত্র।১. Harari, Yuval Noah, 2011, Sapience_ A Brief History of Humankind, Vintage Books, London page -8-9
২. উইকিপিডিয়াসহ অন্যান্য ইন্টারনেট সাইট।