জন্ম নিয়ন্ত্রণের সেকাল- একাল

Jun 14, 2024 - 02:16
Jun 14, 2024 - 02:44
 0  66
জন্ম নিয়ন্ত্রণের  সেকাল- একাল
নাবা , ৮ম, রোল-৮৯

জন্ম নিয়ন্ত্রণ পাপ? না পূণ্য, না, নিতান্ত প্রয়োজন-- এ বিষয়টি যখন কিছুই বুঝতাম না, তখন মনে পড়ে, আমাদের গ্রামের একজন মহিলার ইন্তেকালের কথা। ঐ সময় মহিলাদের হাসপাতালে মারা যাওয়ার খুব একটা সুযোগ হতো না। কিন্তু আমি যার কথা বলছি,তিনি হাসপাতালেই মারা গেছেন। গ্রামে কথা ছড়াল যে, ঐ মহিলা জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘মায়া বড়ি’ খেয়েছিলেন। তাই মারা গেছেন। জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত পিল বা ট্যাবলেট খেলে যে নারীরা মারা যায় না, বিষয়টি তখন কেবল আমি নই, আমার গ্রামের কোন মানুষই জানত না, বুঝত না।

তাই আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম, জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি খেয়েই মহিলাটি মারা গেছেন। অতএব, প্রমাণিত হল যে, জন্ম নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা যে কেবল ধর্মবিরোধীই নয়, জীবন বিরোধীও ।মোল্লাদের জয় জয়কার!

 গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে বাংলা ভূখণ্ডে জন্মনিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুরু হয় বলে জানা যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে সরকারের অগ্রাধিকার খাতগুলোর মধ্যে একটি ছিল জন্ম নিয়ন্ত্রণ। এ খাতে দেশের বাইরে থেকে প্রচুর সহায়তাও পাওয়া যেত বলে প্রচার কার্যক্রমও ছিল চোখে পড়ার মতো। পোস্টার, লিফলেট, ফ্লেয়ার থেকে শুরু করে রেডিও টেলিভিশন ও বায়েস্কোপের মাধ্যমেও চলত জমজমাট প্রচারণা।

 কিন্তু জন্ম নিয়ন্ত্রণের পক্ষের প্রচারণার বিপরীতে চলত মোল্লাদের ধর্ম বাঁচানোর শ্লোগান। 'মুখ দিবেন যিনি, খাবার দিবেন তিনি'। আল্লাহর দেয়া জীবনকে পৃথিবীতে আসতে বাধা দেয়াটা তাই, খোদার উপর খোদগিরি ।

 বাংলাদেশে সরকারিভাবে পরিচালিত কোন কর্মসূচিকে জোর করে বন্ধ করার মতো ক্ষমতা একালের মতো সেকালে মোল্লাদের ছিল না। তাই ওয়াজ মাহফিলে বয়ান, মসজিদের খোতবা কিংবা চায়ের দোকান, গ্রামের চৌরাস্তার আড্ডায় চলত জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরোধীতা। ঐ সময় সুর আর অসুরের যুদ্ধের ময়দান ছিল এসব স্থান।

  আমাদের পাড়ায় জন্ম নিয়ন্ত্রণের সামগ্রী নিয়ে আসা স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রবেশে ছিল কড়াকড়ি নিষেধাজ্ঞা। চুপে চুপে যদি কোন স্বাস্থ্যকর্মী পাড়ায় ঢুকে পড়ত তবে তার যাতায়াত ছিল মূলত তার নিজস্ব আত্মীয়দের বাড়িতে। বেচারির অফিস থেকে নিশ্চয়ই প্রচণ্ড চাপ ছিল জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী বিতরণ করে তার দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকায় জনবিষ্ফোরণ বন্ধ করা। কিন্তু তাদের ব্যবহারিক ঝুঁকির কথা বড় কর্তারা আমলে নিতেন না। তাই কি আর করা দু এক স্থানে কিছু কনডম দিয়ে যেতেন, কোথাও কিছু মায় বড়ি গোপনে ফেলে যেতেন।

 বড়িগুলোর কি অবস্থা হত, আমি জানি না। তবে কনডমগুলো পোলাপানরা বেলুন বানিয়ে আকাশে ওড়াত। গ্রামের ‍মুদির দোকানে কনডমগুলো বেলুন নামেই বিক্রয় হত। দু একজন শিক্ষিত  মানুষ এগুলো আসলে কি বস্তু তা জানলেও পোলাপানদের খেলাধুলায় তারা বাধা দিত না।

 স্বাধীনতাত্তোর কালে দেশে খাদ্য সংকট সহ দারিদ্র্য ছিল চরমে। তাই জন্মনিয়ন্ত্রনের স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের বিনিময়ে এককালীন অর্থপ্রদানের মতোও কিছু কর্মসূচি ছিল। পুরুষগণ ভ্যাসেকটমি ও স্ত্রীগণ লাইগেশনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে বন্ধ্যাত্ব গ্রহণ করলে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগ থেকে তাদের নগদ অর্থ ও পোশাক-আসাক দেয়া হত। পেটের দায়ে এ সুযোগ অনেক দরিদ্র নারীপুরুষই গ্রহণ করেছিল।

  আমাদের গ্রামের এক বাড়িতে বছর-চুক্তিতে কাজ করা এক দম্পতি জন্ম নিয়ন্ত্রণের জন্য ভ্যাসেকটমি ও লাইগেশন অপারেশন গ্রহণ করেছিল। কিন্তু বিষয়টি গ্রামে চাউর হয়ে গেলে তাদের জীবনে ঘটল আর এক বিপত্তি। যে ভাতের সংস্থান করতে গিয়ে তারা জন্মনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, সেই একই অপরাধে তারা একদিকে গ্রামের বছর ধরে কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হল, অন্যদিকে গ্রামের মানুষের তীব্র কটাক্ষ আর উপহাসের পাত্রে পরিণত হল। তাদের কাজ থেকে অব্যাহতি দেয়া হল। স্ত্রীলোকটিকে দেখলে গ্রামের ছেলেমেয়েরা ’খাসি, খাসি’ বলে উপহাস করত। এক সময় কাজ তো দূরের কথা, গ্রামে তাদের ভাগ্যে ভিক্ষে জোটাও মুসকিল হল।

 আমার অভিজ্ঞতামতে স্বাধীনতার পরবর্তী অন্তত দুইটি দশকে বাংলাদেশে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে আমার গ্রামে সামাজিক ও ধর্মীয় বিরোধিতা এমনই কঠোর ছিল। কিন্তু নব্বই এর দশকে এ বিরোধিতা কমতে শুরু করে। এরপর নতুন দশকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বাধা দুর্বল হয়ে কিছুটা টিকে থাকলেও এর বিরুদ্ধে সামাজিক বাধা আর রইল না।

 জন্ম নিয়ন্ত্রণের সামগ্রী বর্তমানে আর বিনামূল্যে পাওয়া যায় না। কোন স্বাস্থ্যকর্মীও এগুলো আর পাড়ায় পাড়ায় ফেরিও করে না। গ্রামের মুদির দোকান থেকে বাচ্চারা কনডম কিনে বেলুন বানিয়ে আর ওড়ানোর ‍সুযোগ পায়না। কারণ মুদির দোকানি এখন জানে, এগুলো খেলনা সামগ্রী নয়। গ্রামের বিবাহিত যুবক-যুবতীরাও জানে জন্ম নিয়ন্ত্রণে ধর্মীয় বাধা থাকলেও তা জীবনের জন্য অপরিহার্য।

 গ্রামের মোল্লারা আর স্বাস্থ্যকর্মীদের গ্রামে ঢুকতে বাধা দেয়না। ওয়াজ মাহফিলের বয়ানের তালিকা থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ফতোয়া এখন উধাও হয়ে গেছে। আমাদের গ্রামের মাওলানা মোল্লাদের সংসারেও এখন আর দুইটার বেশি বাচ্চা হয়না।

 জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি এখন কেবল পরিবার পরিকল্পনা বা জনসংখ্যা কমানোর মধ্যেই সীমীত নেই। বিষয়টি এখন নারীর জন্য স্বাস্থ্য ও পুরুষের জন্ম সংসার পরিচালনার সামর্থ্যের সাথে সম্পর্কযুক্ত। বাচ্চা জন্ম দেয়ার কয়েক মাস পরেই আবার গর্ভবতী হওয়া কিংবা এক বাচ্চা জন্ম দেয়র ১৩/১৪ মাস পরে আর একটি সন্তান জন্ম দেয়া যে কোন নারীর জন্যই সুখকর নয় সেটা এখন নারীমাত্রই উপলব্ধি করতে পেরেছে। অন্যদিকে একজন পুরুষের পক্ষেও কাঙ্খিত নয় যে তার স্ত্রী  পুরো যৌবনকালই একটি বাচ্চা পিঠে ও আর একটি বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরবে।  যৌবনকে ‍উপভোগ করতে হলেও তো এর অবসান চাই।

কুসংস্কার ও ধর্মীয় বিধানের সাথে বিজ্ঞান ও বস্তবতার লড়াই নিরন্তর। প্রাথমিক পর্যায়ে কুসংস্কার সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু বাস্তবতা এক সময় কুসংস্কারকে পরাজিত করে। জন্ম নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করা প্রথম দিকে ছিল নিতান্তই একটি কুসংস্কার। এ কুসংস্কারকে শক্তিশালী করেছিল ধর্ম। কিন্তু বাস্তবতার কাছে নতি স্বীকার করে শেষ পর্যন্ত কুসংস্কারই বিদায় নিয়েছে। আর ধর্ম নীরব থাকার নীতি অবলম্বন করেছে।


মোঃ আব্দুর রাজ্জাক জনাব মোঃ আব্দুর রাজ্জাক এর জন্ম রংপুর জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত ও অপরাধ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর। পেশায় একজন পুলিশ অফিসার। বর্তমানে ৪ এপিবিএন, বগুড়ার অধিনায়ক