ইসলামের প্রথম নারী যোদ্ধা- নুসাইবা বিনতে কা'ব
আরব ইতিহাসে এক নারী বীর সৈনিকের কাহিনী।
নবী করিম হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) এর জীবনী ও সিরাত সংক্রান্ত তথ্য সমারোহে অন্যতম অংশ হচ্ছে উহুদের যুদ্ধ, এর নাম করণ করা হয়েছে মদিনার অদুরবর্তি স্থানে অবস্থিত উহুদ পাহাড়ের নামে । এই যুদ্ধে মহানবীর (সাঃ) জীবনের ও ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার একটি অন্যতম বৃহৎ যুদ্ধ। বদরের পরাজয়ের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মক্কার পক্ষ থেকে এই যুদ্ধের সূচনা করা হয়েছিল। যুদ্ধযাত্রার খবর পাওয়ার পর মুসলিমরাও তৈরী হয় এবং উহুদ পর্বত সংলগ্ন প্রান্তরে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
মুসলমানদের ১০০০ সৈন্য এবং একটি ঘোড়ার একটি ছোট সেনাবাহিনী ছিল, যেখানে কুরাইশদের ৩০০০ সৈন্য, প্রচুর অস্ত্র এবং ৩০০ ঘোড়া ছিল! সংখ্যায় কম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা প্রথমদিকে উহুদ যুদ্ধে সাফল্য লাভ করেছিল। আমাদের নবী (সাঃ)-এর নেতৃত্বে মুসলিম সেনাবাহিনীর শুরুটা ভালো ছিল এবং পরিস্থিতি এমন হচ্ছিল যে মুসলিমরা যুদ্ধে জয়লাভ করছে। নবী (সাঃ)-এর যুদ্ধের নেতৃত্ব প্রদান করছিলেন এবং যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সকল যোদ্ধাদের নিজ অবস্থান ত্যাগ না করার নির্দেশের প্রদান করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। পুরো রণক্ষেত্রে কুরাইশরা কেবল এই একটি ভুলের জন্য অপেক্ষা করছিল, যেই মাত্র মুসলিমদের কৌশলে ত্রুটি পরিলক্ষিত হবে, শত্রুরা সেই সুযোগে সবাইকে ঘেরাও করে পরাজিত করবে।কুরাইশদের বিচক্ষনাতার ফলস্বরূপ যুদ্ধক্ষেত্রে ইসলামের এক শত্রু যখন নবী (সাঃ)-এর কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হয়, তখন মুসলিমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে ও পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। সৈনিকটি নবীজিকে আক্রমণ করতে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই সে তার সামনে একজন মহিলা যোদ্ধাকে দেখতে পেলেন। ঢালবিহীন এবং হাতে কেবল একটি তরবারি নিয়ে, এই মহিলা যোদ্ধা নবী (সাঃ)-কে চারদিক থেকে রক্ষা করে যাচ্ছিল। নবীজির উপর এগিয়ে আসা প্রতিটা আক্রমনের উত্তর খুবই শক্ত হাতে ও তড়িৎ গতিতে দিচ্ছিল। সেই বীর নারী যোদ্ধার প্রতি নবী করিম (সাঃ) এর উক্তি ছিল এরূপ যে- "আমি যেদিকেই দৃষ্টি ফেরাই, ডানে বা বামে, আমি তাকে আমার জন্য লড়াই করতে দেখেছি" ।
তাঁর নাম নুসাইবা বিনতে কা'ব (রাঃ)। তিনি ছিলেন একজন মা, একজন স্ত্রী এবং রণক্ষেত্রে ইসলাম রক্ষাকারী একজন যোদ্ধা। তিনি ছিলেন ইসলামের প্রথম আনসার মহিলাদের মধ্যে একজন যিনি নবী (সাঃ)-এর সাথে দেখা করেছিলেন এবং ইসলামকে রক্ষা করার দায়িত্বে আনুগত্যের প্রদান করেছিলেন। একজন যোদ্ধা হিসেবে তিনি এতটাই দক্ষ, সাহসী এবং হিংস্র ছিলেন যে তার সমসাময়িকদের তিনি হতবাক করে দিতেন। তার পরাক্রমতার গাথা দিকে দিকে ধ্বনিত হত। নবী (সাঃ) তার প্রশংসায় বলেছিলেন-"হে উম্মে উমারা (নুসাইবা রাঃ-কে তার ছেলের নামানুসারে উমারার মাও বলা হত) তোমার মতো সাহস আর কেউ কোথা থেকে পাবে" ।
তার দুই ছেলে এবং স্বামী একই ময়দানে উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে "উহুদের যুদ্ধে" তার সাথে যুদ্ধ করেছিল। এই যুদ্ধে যখন তিনি তার ছেলের আক্রমণকারী সৈনিকদের খুঁজে বের করে এবং নিজের জীবনের ভয় উপেক্ষা করে তাদের পরাস্ত্র করে তার ছেলের প্রতিশোধ নেয়, এটি ছিল তার সাহসিকতার অন্যতম আরেকটি নিদর্শন।
নুসাইবা (রাঃ) আনহু যুদ্ধে দুই ছেলে এবং তার স্বামীকে হারিয়েছিল, তবুও তিনি অটল ছিলেন। যেখানে অন্য সাধারণ নারী-পুরুষ এভাবে সব হাড়িয়ে নিঃস্ব হয়ে ভেঙ্গে পরত, তিনি খনিকের জন্যও নিথর হননি, তিনি আতঙ্কিত হননি, বরংচ তিনি হাতে তরবারি তুলে নিয়ে প্রলয়ের ন্যায় যুদ্ধ করেছিলেন, সম্পূর্ণরূপে চতুরতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। তার চিন্তা ভাবনায় তিনি ছিলেন স্পষ্ট ও দৃঢ় সংকল্প।
তিনি হুনাইন, খায়বার এবং ইয়ামামার যুদ্ধেও লড়াই করেছিলেন, সেখানে তাকে একটি হাত হাঁড়াতে হয়। সেই সময়, তার বয়স ছিল ৬০ বছর। তিনি আরব মুসলিম সমাজে অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। হযতর আবু বকর আল সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু এবং হযতর ওমর (রাঃ) নিকটও গুরুতর ভাবে বিবেচিত ছিলেন।
তার জীবনাদর্শন এমন একজন নারীরা উদাহরণ যিনি সমাজে সব ক্ষেত্রেই সমান অবদান রাখতে পারে, তিনি তার মন, সাহসিকতা তার চিন্তা ভাবনা দিয়ে নারীদের একজন পথিকৃত এবং পরবর্তীতে তাকে অনুসরণ করে অনেক আরব নারীরা এরূপ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এনং বীরত্বের নিদর্শন রাখেন। নুসাইবা রাদিয়াল্লাহু আনহু বিভিন্ন স্তরে এত যুদ্ধ করেছেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি অপরিসীম সাহস রাখতে পারতেন। তিনি দেখিয়েছেন যে একজন ব্যক্তি একই সাথে নারীত্বপূর্ণ এবং শক্তিশালী হতে পারেন, যে নারী বিনয়ী হতে পারে সে যোদ্ধাও হতে পারে, একজন দয়ালু এবং করুণাময় এবং একই সাথে হিংস্র হতে পারে।
আরবের সেই পুরাতন সভ্যতায় যেখানে নারীদের কেবল ভোগ বিলাসের বস্তু মনে করা হত, তিনি ইসলামের প্রথম নারী যোদ্ধা হয়ে নিজের স্বামী-পুত্রের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজের বিক্রমতার আলামত দেখিয়েছেন, নবীজিকে আহত হওয়া থেকে রক্ষা করে যুদ্ধের বিজয় তুলে এনেছেন। তিনি বীরঙ্গনার মত তরবারি তুলে নিয়েছিলেন, তার চোখে হিংস্রতা, তার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট তরবারি চালনা, তার যুদ্ধের দক্ষতা এবং যুদ্ধক্ষেত্রে নবী (সাঃ)-কে রক্ষা করার জন্য প্রথম মহিলা হওয়া কত সম্মানের ছিল। ইসলামি ইতিহাসে তার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। কিন্তু পুরুষপ্রধান অলি-ওয়ালামাগন তাদের বয়ানে এসব কখনওই জাহির হতে দেন না। এমন কি ধর্ম প্রচারনায় তৎকালীন নারীদের চরিত্রগুলোকে গোপন রাখার চেষ্টা করেন। নারীদের দুর্বল ভাবে রূপে প্রকাশ করেন। সবার কথা বলব না, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরুষ তান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই তাদের লক্ষ্য। আমারা যারা শিক্ষিত, সমাজে অগ্রগণ্য তাদের উচিৎ পবিত্র কুরআনের মর্মার্থ নিজে অনুধাবন করা, সকল অপব্যাখ্যাকে উপেক্ষা করে প্রকৃত ইসলাম এর তাৎপর্য সবার সামনে তুলে ধরা ।