‘অভ্র’- ইউনিকোড তৈরির আদ্যোপান্ত

Jul 1, 2024 - 03:08
 0  24
‘অভ্র’- ইউনিকোড তৈরির আদ্যোপান্ত
Inventor of Avro Dr. Mehidi Hasan Khan

‘অভ্র’- ইউনিকোড তৈরির আদ্যোপান্ত

ঢাকার আইডিয়াল স্কুলে অধ্যয়নরত প্রাণ চঞ্চল এক কিশোর মেহেদী হাসান খান, জন্ম ১৯৮৬  সালে। ছাত্র বয়স থেকেই  তার চোখে ডাক্তার হবার অদম্য স্বপ্ন পাশাপাশি ছিল কম্পিউটার প্রোগ্রামিং শেখার প্রবল ঝোঁক। তখনও বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট লাইন সেভাবে বিকশিত হয়নি, ফেসবুক আর ইউটিব, সেতো আরও কল্পনাতীত, তাই এখনকার মত ইন্টারনেটে ভিডিও দেখে কোনকিছু শিখে নেবার মত সুযোগ তখনও তৈরি হয়নি। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া এই ছেলে দোকান থেকে বই কিনে একা একা প্র্যাকটিস করেই প্রোগ্রামিং শিখত। নিজ স্বপ্ন এমবিবিএস পড়ার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে নটরডেম কলেজ থেকে পাশ করে ভর্তি হয় ময়মসিংস্থ সরকারী মেডিকেল কলেজে।

সে সময় ধীরে ধীরে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যাবহারের ব্যাপকতা শুরু হলেও, নেট দুনিয়ায় বাংলার ব্যাবহার সম্ভবপর ছিল না। ছিলনা বাংলায় মেইল পাঠানো ও ওয়েবসাইট তৈরি করার সুবিধা। বাংলার প্রয়োজন হলে, বাংলা লেখার ছবি দিয়ে বাংলা ওয়েবসাইট তৈরি করতে হতো, এভাবে ওয়েবসাইট নির্মাণ প্রক্রিয়াটি যুদ্ধ করার মত কঠিন আর মানের দিক থেকেও হত খুব দূর্বল। 

মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় ২১ এর বই মেলায় বায়োস(বাংলা ইনোভেশন থ্রু ওপেন সোর্স)-এর স্টলে সে প্রথম দেখতে পেল সরাসরি বাংলায় লেখা ওয়েবসাইট ও প্রথম বাংলা অপেরাটিং সফটওয়্যার ‘ইউনিবাংলা। এখানে ক্যারেক্টার চার্টে মাউস দিয়ে ক্লিক করে করে বাংলা লিখতে হত, আর ঐ সফটওয়্যারটি ছিল মূলত সার্ভার বেইজড অপারেটিং সিস্টেম লিনাক্সের জন্য। বিশ্বে সর্বাধিক ব্যাবহৃত অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজের জন্য নয়। হোস্টেল রুমে ফিরে এসে ওদের ওপেন টাইপ ফন্ট নামিয়ে বাংলা লেখার অনেক চেষ্টা করেও মেহেদী সফল হতে পারনি। সে সময়ই উইন্ডোজ ব্যবহারকারীদের জন্য বাংলা সফটওয়্যার নির্মাণের প্রতি তার এক তীব্র কৌতুহল সৃষ্টি হয়। এই আকাঙ্খাই হয়ে ওঠে তার অভ্র সফটওয়্যার উদ্ভাবনের মূল অনুপ্রেরণা।

ভার্চুয়াল জগতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের স্বাধীনতাই হয়ে উঠল তার একমাত্র লক্ষ্য। সে চাইত, সবাই সহজ ভাবে কিবোর্ডে ফোনেটিক (উচ্চারনভিত্তিক) শব্দ ইংরেজিতে টাইপ করবে, আর নিজ থেকেই সেটা বাংলায় রুপান্তরিত হয়ে যাবে,  এমন ভাবনা থেকেই শুরু হোল তার গবেষণা। মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের কক্ষটি-ই হয়ে উঠল তার গবেষণাগার। দরজা বন্ধ করে চলতে থাকল নিরবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা আর তারই ফলশ্রুতিতে আবির্ভাব ঘটে এএনএসআই সাপোর্টেড নেট দুনিয়ার জনপ্রিয় বাংলা সফটওয়্যার অভ্রর। মাত্র ১৮ বছর বয়সে মেহেদী হয়ে ওঠে বর্তমানের জনপ্রিয় ইউনিকোড সফটওয়্যার  ‘অভ্র-এর জনক। বাঙালি জাতি অর্জন করে বাংলায় তথ্য আদান-প্রদান করার ডিজিটাল ভাষা স্বাধীনতা, যার প্রতীক সরূপ ২০০৩ সালের ২৬ শে মার্চে, স্বাধীনতা দিবসে অভ্র সফটওয়ারটি প্রথম উন্মুক্ত করা হয়।

মেডিকেল কলেজের সিনিয়র ভাইয়েরা যখন মেহেদীকে প্রশ্ন করলো “তা তোর সফটওয়্যার এর দাম কত নিবি? সাধাসিধে এই দেশপ্রেমিক তরুনের উত্তর ছিল “ভাষার জন্য টাকা নিব কেন!” এটি সবার জন্য উন্মুক্ত, সে থেকেই সফটওয়্যারটি স্লোগান হয়েছে- “ভাষা হোক উন্মুক্ত- প্রতি বার সফটওয়্যার রান হলে স্লোগানটি ভেসে ওঠে, নামকরণ করা হয়েছে “অভ্র- অর্থ আকাশ, ভাষা প্রকাশের এক উন্মুক্ত আকাশ।    

ব্যবহার সহজ হওয়ায় এটি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরবর্তিতে এর পুনঃ পুনঃ সংস্করণের ও আধুনিকায়নের জন্য ডিজিটাল সমাজে বর্তমানে এটি সর্বাধিক সমাদৃত। তৈরি হয়েছে অভ্রর ম্যাক ও এন্ড্রয়েড ভার্সন, মোবাইল ফোনে  যে কোন সল্প শিক্ষিত ব্যাক্তিই সহজে বাংলায় লিখে ইন্টারনেট ব্যাবহারের সুবিধা পাচ্ছে । কিশোর বয়সে মেহেদিকে মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখা ‘ওমিক্রন কল্পকাহিনীটি বেশ মুগ্ধ করে, প্রিয় উপন্যাসের নামকরনে অভ্র সফটওয়্যারের অফিসিয়াল অয়েবসাইটটির নাম দিয়েছে ওমিক্রনল্যাব। কিন্তু তার পুরো ওয়েবসাইট জুড়ে বা গুগলে সার্চ দিলেও পাওয়া যাবে না সম্পূর্ণ প্রচার  বিমুখ এই তরুণের কোন ছবি, নেই কোন চাওয়া পাওয়া। বর্তমানে সরকারীভাবে ভারত ও বাংলাদেশ দুই বাংলায় জাতীয় পরিচয়পত্র ও অনলাইন পাসপোর্ট  তৈরীতে এটি বিনামূল্য ব্যাবহৃত হচ্ছে। এতে সাশ্রয় হয়েছে বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি টাকা।

এই পুরো ঘটনাটি খুব চমকপ্রদ মনে হলেও, এই সফলতার সোপানটি মোটেও কিন্তু সহজ ছিল না। বিনামূল্য সফটওয়ারটি উন্মুক্ত করায় অনেক পুঁজিবাদী সফটওয়্যার বিক্রেতাদের নগদ নারায়ণে ভাটা পরায় তারা নানা ভাবে মেহেদীর পথে বাঁধ সেধে দাড়ায়, আইনি নোটিশ সহ মোকাবেলা করতে হয়েছে অসহনীয় বিড়ম্বনা। মেহেদী খুবই বলিষ্ঠতার সঙ্গে সকল চড়াই উতরাই অতিক্রম করে, কোন বাধাই প্রশমিত করতে পারেনি তার এই অদম্য ইচ্ছাকে । কোন এক তৃতীয় পক্ষ মেহেদীর জন্য একুশে পদকের আবেদন করতে চাইলে, তাতেও আপত্তি জানায় সে। হয়তো এমন মানুষদের জন্যই বাংলা অভিধানে অতিমানব শব্দটি রাখা হয়েছে।

 

জনকল্যানের চেতনায় বলীয়ান হয়ে একমাত্র উৎসর্গ হওয়াতেই যারা নিজের সার্থকতা খুজে পায়, তাদের কাছে সকল স্বীকৃতি, নাম-যশ ও সকল অর্থই তুচ্ছ। ডিজিটাল ভাষা সৈনিক খ্যাত ডাঃ মেহেদী হাসান খান এই ধরণীর বুকে প্রজ্বলিত এক মঙ্গল দ্বীপ।বাংলাদেশের বুকে যতদিন এমন দামাল ছেলেদের জন্ম হতে থাকবে, ততদিন এই দেশ, এই মাটির সমৃদ্ধি ক্রমে বাড়তে থাকবে।